ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বন্যহাতির তাণ্ডবে ছয় বছরে নিহত ১১০ বান্দরবানে

এনামুল হক কাশেমী, বান্দরবান ::
জঙ্গলে বন্যপ্রাণির খাবার সংকট, বিচরণভুমি ক্রমেই সংকোচিত হয়ে আসা এবং পরিবেশ বিপর্যয় হয়ে পড়ায় বান্দরবান জেলায় বন্যহাতির হামলা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সমাজনেতাদের তথ্য মতে গত ৬বছরে জেলার সদর, লামা এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নানাস্থানে বন্যহাতির হামলায় নিহত হয় ১১০জন কৃষক ও গ্রামবাসী। এ সময় গুরুতর আহত হয় ৮৫০জন। একই সময়ে হাতির তান্ডবে ১ হাজার ১৫০টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয় এবং েতের পাকাধানসহ বিভিন্‌ ফসল বিনষ্ট হয় ১ হাজার ৮০০ একর জমির।

শত শত পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে ভিটেমাটিও ত্যাগ করেন। কিন্তু এযাবত এসব সমস্যার সমাধনে কোন মহলই এগোয়নি। ফলে জেলার দুর্গম এলাকাসমুহে মানুষের বসবাস অনিরাপদ হয়ে ওঠছে। গত ৬ বছরের তথ্য মতে জেলার বান্দরবান সদর,লামা এবং নাই ংছড়ি উপজেলার নানাস্থানে শতাধিক গ্রামবাসী নিহত হয়েছেন বন্যহাতির তান্ডবে।

এ সময় সাড়ে ৮০০ লোক গুরুতর আহত হয়। ১১ শ’৫০টি বসতঘর বিধ্বস্ত হয় এবং ১ হাজার ৮০০ একর জমির ফসল বিনষ্ট করে বন্যহাতির দল। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রশাসন থেকে কিছু ত্রাণ ও নগদ অর্থ বিতরণ করেই দায়িত্ব শেষ করা হয় প্রশাসন পর্যায়ে। কিন্তু দুর্গম এলাকার মানুষদের বন্যহাতিসহ বনের হিং্র জীব–জন্তুদের হাত থেকে নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে স্থায়ী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি এখনও।

জেলার লামা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসমাইল, ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান মো.জাকির হোসেন মজুমদার এবং ফাইতং ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আলম জানিয়েছেন, বন্যহাতির হামলা ও তান্ডবের শিকার হয় বেশি লামা উপজেলার দুর্গম এলাকাসমুহের মানুষ।

স্থানীয় ও ক্ষতিগ্রস্তদের তথ্যের বরাতে নেতৃবৃন্দ বলেন, গত ৬ বছরে কেবল লামা উপজেলার ৪টি ইউনিয়নেই বন্যহাতির হামলায় একজন জামে মসজিদের ইমামসহ ৫৪জন গ্রামবাসী ও কৃষক নিহত হয়েছেন। এ সময় বন্যহাতির হামলায় গুরুতর আহত হন প্রায় ৫০০ গ্রামবাসী এবং প্রায় ৪০০ বসতঘর বিধস্ত হয়। একই সময়ে এ উপজেলার নানাস্থানে ১ হাজার একর জমির ফসলও বিনষ্ট করে হাতির দল।

বান্দরবান সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম আবদুল কুদ্দুছ বলেন, রাজবিলা,সুয়ালক এবং টংকাবতি ইউনিয়নের দুর্গম এলাকাসমুহে বন্যহাতির তান্ডবে গত ৬বছরে কমপক্ষে ২৫জন গ্রামবাসী ও কৃষক নিহত হয়েছেন। একই সময়ে গুরুতর আহত হয় ২০০ গ্রামবাসী। ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হয় প্রায় ৩০০ একর জমির। বসতঘর বিধ্বস্ত হয় প্রায় ৩০০টি।

নাই ংছড়ি উপজেলার সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল হামিদ ও দোছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান হাজী হাবিব উলহ্মাহ বলেন, বাইশারী, দোছড়ি এবং সোনাইছড়ি ইউনিয়নের নানাস্থানে গত ৬ বছরে বন্যহাতির হামলায় নিহত হয় ৪০ জন গ্রামবাসী ও কৃষক। এ সময় বসতঘর বিধ্বস্ত হয় ৫শতাধিক এবং প্রায় ৫০০ একর জমির ফসলও বিনষ্ট করা হয়।

সমাজনেতাদের মতে বন্যহাতিসহ জঙ্গলী জীব–জন্তু থেকে নিরাপদে থাকার লক্ষ্যে এসব এলাকার শত শত পরিবার সাম্প্রতিক সময়ে ভিটেমাটি ত্যাগ করেছেন। এসব পরিবারের বহু পরিববারই এখন বসবাস করছেন উচুঁপাহাড় ও পাহাড়ি টিলায়। পাকাধানসহ ক্ষেতের ফসল রক্ষায় কৃষকরা ‘টংঘর’ নির্মাণ করে গাছের ডালে রাত কাটায়।

সাম্প্রতিক সময়ে দফায় দফায় বন্যহাতির হামলায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনার পর থেকেই গ্রামবাসীরা গাছের ওপর বা গাছের ডালে ‘টংঘর’ নির্মাণ করে রাত কাটানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। স্থানীয়দের দাবি বন বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত দুলাহাজারা সাফারি পার্ক বা ওই এলাকায় অভয়ারণ্য সৃষ্টি করে সেখানে বনের হাতিসহ হিংস্র প্রকৃতির জীব–জন্তুগুলো আটক করে রাখার জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

বন্যহাতির আক্রমণে একের পর এক প্রাণহানীর ঘটনা অব্যাহত থাকায় দুর্গম এলাকার মানুষ চরম অনিরাপদে দিনযাপন করছেন বর্তমানে। সদর উপজেলা কাইচতলী এলাকার বন্যহাতির হামলার শিকার রফিকুল আলম ও আবুর হোসেন বলেন, তারা বন্যহাতির তান্ডব থেকে রেহাই পেতে নানামুখী কৌশল হতে নিয়েছেন। সন্ধ্যার পর থেকেই স্বউদ্যোগে পাহারা বসিয়ে থাকেন গ্রামবাসীরা।

লামা উপজেলার হারগেজা ও তীরেরডেবা গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম, জাফর আলম এবং সৈয়দ নুর বলেন, প্রায় প্রতিরাতেই বনের হাতিগুলো হানা দেয় তাদের গ্রামে। তাদের এই ২টি গ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে বন্যহাতির হামলায় নিহত হয় ৭জন। তারা রাতে পাহারা বসিয়ে থাকেন নিরাপত্তার তাগিদে।

ওই তিন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দাবি করেন স্থানীয় বন বিভাগের সহায়তায় তারা বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। বন্যহাতির হামলায় সাম্প্রতিক সময়ে নিহত ও আহতদের মাঝে নগদ টাকাসহ ত্রাণ বিতরণ করা হয়ে থাকে সময়ে সময়ে।

লামা এবং বান্দরবান সদরের বন কর্মকর্তারা বলেন, জঙ্গলে নতুন নতুন বসতি স্থাপন এবং প্রতিবছরই নানাস্থানে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ে জুমচাষ বৃদ্ধি পাবার কারণে বন্যহাতির বিচরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে লোকালয়ে। বন্যপ্রাণীর এসব এলাকায় খাবার সংকোচিত হয়ে আসছে। ফলে লোকালয়েই হানা দিচ্ছে বন্যহাতির দল। বন কর্তাদের দাবি–সাম্প্রতিক সময়ে বেশকটি বন্যহাতি আটক করে দুলহাজারা সাফারি পার্কে রাখা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: