ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

লামায় পাহাড়ে জুমিয়াদের আগুনে জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে

লামা প্রতিনিধি :

বান্দরবানের লামা উপজেলার পাহাড়ে পাহাড়ে এখন জুম চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি জুমিয়ারা। ইতিমধ্যে তাদের পাহাড় বাছাই এবং বাছাইকৃত পাহাড়গুলোর গাছপালা, গুল্ম ও লতাপাতা কেটে ফেলার কাজ শেষ করে এখন শুধু পাহাড়গুলোতে আগুন লাগিয়ে পোড়ানো হচ্ছে। গত ১৫-২০ দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এ জুমের আগুনে পুড়েছে অর্ধশতাধিক পাহাড়। জুমে আগুনের সময়কালীন আকাশ কালো ধোঁয়া আর আগুনের কুন্ডলীতে মেঘাচ্ছন্ন ও উত্তপ্ত বাতাস প্রবাহিত হয়। প্রচন্ড দাবদাহে নদী, খাল বিল ও ঝিড়ির পানি শুকিয়ে যায়। এতে পেটের পিড়াসহ ডায়রিয়া আমাশয় ও বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে এলাকার লোকজনের মাঝে। আগুনে পুড়ে সাময়িক মাটি উর্বর হলেও পরোক্ষনে দ্রুত শুকিয়ে চাষাবাদের অনুপোযোগী হয় মাটি। তাছাড়া সবুজ বন পুড়ে ছাই হওয়ার কারণে বর্ষা মৌসুমে মাটি ধ্বসে খাল, বিল, নদী নালা ভরাট হয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তাদের জীবন জীবিকা এখনো প্রায় জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ি জেলায় কৃষি জমির পরিমাণ অতি সামান্য বিধায় বাধ্য হয়ে জুমিয়ারা সনাতন পদ্ধতিতে জুম চাষ করেন। জুমে ধান, ভুট্টা, পেঁপে, কলা, আনারস, মারফা, চিনার, মরিচ, তুলা, আলু (সাদা আলু), কাসাভাসহ (শিমুল আলু) নানা ফসল রোপন করা হয়। এ চাষের বিকল্প কোন চাষের উদ্ভব এখনো না হওয়ায় প্রতিবছর জুমিয়াদের লেলিয়ে দেয়া আগুনে প্রত্যন্ত পাহাড়ের প্রায় ৬০ শতাংশ সবুজ বনভূমি পুড়ে ন্যড়া পাহাড়ে পরিণত হয়। মাটি শুকিয়ে বর্ষা মৌসুমে ধসে পড়ে পাহাড়। ক্ষয় হয়ে যাওয়া মাটি পড়ে ভরাট হয় ঝিরি, খাল, বিল ও নদী। আর এ কারণে বর্ষা মৌসুমের সামান্য বৃষ্টিপাতে নিম্মাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়। বিলুপ্ত হয় পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। তবে কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, জুমের বিকল্প চাষে উৎসাহিত করার কারনে সনাতনী জুম প্রথা থেকে সরে আসছে জুমিয়ারা।

উপজেলার গজালিয়ার জুমিয়া অংহ্লাপ্রু মার্মা বলেন, এক পাহাড়ে পর পর দুই বার জুম করা হয় না। কারণ এক পাহাড়ে বার বার ফসল ভালো হয় না। তাই একেক বছর একেক পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। এখন পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে গাছপালা, গুল্ম ও লতাপাতা পোড়ানো হচ্ছে। এরপর সামান্য বৃষ্টি হলেই ফসল রোপন শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, এখনো এ চাষের বিকল্প কোন চাষের ব্যবস্থা না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে এ চাষ করছি। চলতি মৌসুমে সরকারী হিসাবমতে এবার জেলায় ১৫-২০ হাজার হেক্টর পাহাড়ী ভুমিতে জুম চাষ করা হবে বলে জানা গেলেও বেসরকারী ভাবে এর পরিমাণ বেশি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পার্বত্য তিন জেলায় জুম চাষের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কাজ করেছে সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএফএসডি) নামের এক প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, প্রথাগত চাষ পদ্ধতি হিসেবে জুম চাষ কয়েকশ’ বছর ধরে চলে এলেও পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর এটা বিরূপ প্রভাব ফেলে। তবে জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পাহাড় থাকলে জুম চাষের সময়ের আবর্তনটা সঠিকভাবে রক্ষা করা সম্ভব। আর এ সময় আবর্তনটা ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ধরে রাখা গেলে যেটুকু বিরূপ প্রভাব ফেলে তা প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম। এখন যে হারে জুম চাষ হচ্ছে তাতে প্রাকৃতিক বনজ সম্পদ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মৃত্তিকা ক্ষয়ও বাড়ছে। ফলে প্রাকৃতিক ছড়া-নালা বর্ষাকালে ধুয়ে আসা মাটিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে পানীয়জলের সংকট প্রকট হয়। তবে সংগঠনটি জুম চাষের জন্য কোনো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অপরাধের দৃষ্টিতে না দেখে জুম চাষিদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য স্থায়িত্বশীল বিকল্প চাষাবাদ পদ্ধতি চালুর ওপর জোর দিয়েছে। আদি পদ্ধতির এ জুম চাষ বছরের পর বছর ধরে ধ্বংস করে দিচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। এভাবে বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হাড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতি প্রাণীজ সম্পদ। জুমিয়া পরিবারগুলো পুরো এক বছরের খাদ্য শষ্য ঘরে তুলতে পারলেও এ জুম চাষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটির ক্ষয় হয়।

জানা গেছে, জুম চাষ থেকে বিরত রাখতে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম নিয়ন্ত্রণ নামে বন বিভাগের একটি শাখা রয়েছে। এ ছাড়া আশির দশকে সরকারি উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে জুমিয়া পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় কয়েক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। স্থায়ীভাবে জীবনযাপনের মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারায় এ প্রকল্পটি কোনো কাজে আসেনি। অভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, জুম চাষের ফলে পাহাড়ে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের বায়ুও দূষিত হয়ে পড়ে। জুমের নামে পাহাড় পোড়ানোর সময় স্থানীয়ভাবে বাতাসে ছাইয়ের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে লোকজনের মাঝে নানা ধরনের শ্বাসজনিত ব্যাধি দেখা দেয়। অন্যদিকে পাহাড়ি মাটির রস দ্রুত শুকিয়ে শত শত পাহাড় ধসে পড়ে। হারিয়ে যায় পাহাড়ের বসবাসরত নানা জীবজন্তু। পাশাপািিশ হুমকি মুখে পরিবেশ ভারসাম্য।

লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নুরে আলম বলেন, প্রতি বছর শত শত একর পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে জুম চাষ করা হয়। আর জুম চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করতে পোড়ানো হয় পাহাড়ের পর পাহাড়। তাই জুমচাষের ক্ষতিকারক দিকগুলো জুমিয়াদের মাঝে তুলে ধরে তাদের এ চাষের বিকল্প হিসাবে কমলাসহ মিশ্র ফসল চাষে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে আগের তুলনায় জুম চাষের নামে পাহাড় পোড়ানো কমে এসেছে।

পাঠকের মতামত: