ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

রামুতে দেড় হাজার চুল্লিতে তামাক পাতা পোড়ানো হচ্ছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা

SAMSUNG CAMERA PICTURES

সুনীল বড়ুয়া, রামু ::

কক্সবাজারের রামু উপজেলার শস্যভান্ডার খ্যাত পূর্বাঞ্চলীয় গর্জনীয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে এক সময় বিস্তীর্ণ জমিতে শাক সব্জির আবাদ করা হত। সেখানে এখন শুধু তামাক আর তামাক। বর্তমানে এসব এলাকায় ঘরে ঘরে চলছে তামাক শুকানো ও আটি বাঁধার কাজ শেষ করে পোড়ানো হচ্চে তামাক।

বিভিন্ন এলাকায় তামাক পোড়ানোর জন্য প্রায় দেড় হাজার চুল্লি (তন্দুর) স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে বনভুমিতেও আছে কয়েক’শ চুল্লি। সব চুলিহ্মতেই তামাক পাতা পোড়ানোর কাজ চলছে। এসব চুল্লিতে জ্বালানী হিসাবে মৌসুমে প্রায় সাড়ে সাত লাখ মণ বনের কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। তামাক শুকানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও বয়স্কদের পাশাপাশি কাজ করছে প্রায় দশ হাজার শিশু।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং চাষীদের মতে, কৃষিজমি, বনভুমি, নদীর পাড়, সরকারি খাস জমিসহ প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে এ বছর তামাকের চাষ করা হয়েছে। প্রতি দুই একর জমির তামাক পোড়ানোর জন্য একটি চুল্লির প্রয়োজন পড়ে। সে হিসাবে আড়াই হাজার একর জমির তামাক পোড়ানোর জন্য প্রায় দেড় হাজার চুল্লির দরকার। আর একটি চুল্লিতে প্রতি মৌসুমে ৫০০–৭০০ মণ কাঠ জ্বালানী দরকার হয়। গড়ে ৫০০ মণ ধরা হলেও দেড়হাজার চুল্লিতে মৌসুমে সাড়ে সাত লাখ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। যার সিংহভাগই সামাজিক বনায়নের চারাগাছ। শুধু তাই নয়,বনভুমিতেও বসানো হয়েছে কয়েকশ তামাকের চুল্লি। তবে কৃষি বিভাগের মতে, বনভূমি, খাসজমি, নদীর পাড়, ছাড়া এ বছর প্রায় ৩০০ হেক্টর বা আটশশো একর কৃষি জমিতে তামাক চাষ করা হয়েছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, রামু উপজেলার গর্জনীয়া, কচ্ছপিয়া এবং কাউয়ারখোপ ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশী তামাকের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে গর্জনীয় নতুন মিয়াজী পাড়া, দো’ছড়ি, ঘিলাতলী, শুকমনিয়া, মৌলভীকাটা, তিতারপাড়া, ফাক্রিকাটা, নাপিতের চর, ডাকভাঙা, মাঝির কাটাসহ প্রায় পঞ্চাশটি গ্রামে আশংকা জনকভাবে তামাকের চাষ হয়েছে। এছাড়াও উপজেলার ফতেখারকুল, রাজারকুল, কাউয়ারখোপ, খুনিয়াপালং, ঈদগড়, জোয়ারিয়ানালার বিভিন্ন স্থানে তামাকের আগ্রাসন চোখে পড়ে।

গর্জনীয়ার মাঝিরকাটা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই আছে তামাকের চুল্লি। যারা বেশি চাষ করেছেন তাদের আছে একাধিক চুল্লি। বনভূমি, ক্ষেত, বসত বাড়ির আঙ্গিনা, এমনকি বসত ঘরের সাথে লাগিয়েও চুল্লি করেছেন অনেকে।

তামাকচাষী মো. তৈয়ব ও মো. মান্নান জানান, প্রতি দুই একর তামাক শুকানোর জন্য একটি চুল্লি লাগে। তাই জায়গার অভাবে বাধ্য হয়ে চাষিরা বাড়ির আঙ্গিনায় চুল্লি তৈরী করেন। প্রতিবছর চুল্লিতে আগুন ধরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও না করে উপায় নেই।

তামাক চুল্লিতে কাজ করা একজন শ্রমিক জানান, প্রতিটি চুল্লিতে মৌসুমে ৫০০–৭০০ মণ জ্বালানী লাগে। কিন্তু বনে এখন পরিপক্ক গাছ না থাকায় সামাজিক বনায়নের চারা গাছ কেটে এখানে সরবরাহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বন উজাড় হয়ে যাওয়ায় এখন চড়া দামেও সময় মত কাঠ মিলছে না।

শুধু তারা নন, বসত ঘরের আঙ্গিনায় আরো অসংখ্য চাষী তামাক পোড়ানোর চুল্লী করেছেন। ঘরের পাশে বনভূমিতেও তামাক পোড়ানোর চুল্লির সংখ্যা কম নয়। আর ঘরের ভেতরেই মজুদ করা হয় বিপুল পরিমাণ তামাক পাতা।

নাম প্রকাশে অনিশ্চুক কয়েকজন তামাক চাষী জানান, তামাক শরীরের জন্য ক্ষতিকর জেনেও বাধ্য হয়ে তা করছেন। কিন্তু বিকল্প কোন সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে ঘরেই মজুদ করতে হচ্ছে।

গর্জনীয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. তৈয়বুল্লাহ চৌধুরী জানান, এক সময় গর্জনীয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন শাক–সব্জি ও কাঁচামালের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তামাক চাষ করা হচ্ছে এই দুই ইউনিয়নে। বর্তমানে পুরোদমে তামাক শুকানোর কাজ চলছে। তারা জানান, বনভুমিসহ শুধুমাত্র এ দুই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে একহাজার দুইশ–তিনশ চুল্লিতে বর্তমানে তামাক পাতা শুকানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা :

স্থানীয় বাসিন্দা মহিবুল্লাহ চৌধুরী জিল্লু জানান, বর্তমানে তামাক চাষীদের বাড়ী–ঘরের প্রতিটি কক্ষ তামাক পাতায় ভরে গেছে। এসব পরিবারের নারী–পুরুষ এবং শিশুরা তামাক পাতা শুকানো এবং আটি বাধার কাজে ব্যস্ত। আবার কম পারিশ্রমিকে পাওয়ায় চুল্লিতে তামাক শুকানোর কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের ।

তিনি বলেন, তামাকের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে চাষীদের কিছুটা ধারণা থাকলেও অধিক লাভের আশায় স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি তাদের কাছে তুচ্ছজ্ঞান। ফলে বয়স্কদের পাশাপাশি অসংখ্য শিশু তামাকের বিষাক্ত নিকোটিনের প্রভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকির হুমকীতে পড়ছে । স্থানীয়দের দাবি, উপজেলায় কম হলেও দশহাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অরুপ দ্‌ত্ত বাপ্পী জানান, তামাকের বিষাক্ত নিকোটিনের প্রভাবে শিশুদের শ্বাস কষ্ট, রক্তনালী সংকোচন, হাঁফানি এবং বয়স্কদের হৃদরোগ,ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে ।

উপজেলা বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি ও রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাং শাজাহান আলী জানান, মানুষের অসচেতনতার কারণে তামাক চাষ বাড়ছে। বনভুমিতে তামাক চাষ বন্ধে বনবিভাগকে আরও সক্রিয় হতে হবে। তামাকের তন্দুরে শিশু শ্রমের ব্যাপারে তিনি বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে অনেক প্রচার প্রচারণা চালানো হলেও তা রোধ করা যাচ্ছে না।

পাঠকের মতামত: