ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

বর্ষবরণ ঘিরে উৎসবমুখর পাহাড়ী জনপদ

বান্দরবান প্রতিনিধি ::

বাংলা নববর্ষ এবং মারমা জনগোষ্ঠীর সাংগ্রাইং, চাকমাদের বিজু, ত্রিপুরাদের বৈসু, তঞ্চঙ্গাদের বিষু এবং ম্রো, চাক, খেয়াং ও খুমি জনজাতির চাংক্রান উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাগুলো এখন উৎসবের আমেজে ভরপুর।

সারাদেশের মতো ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ উৎসবের পাশাপাশি পাহাড়ে বসবাসকারী ১১টি জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকেন্দ্রিক বর্ণিল ও ঐতিহ্যবাহী আয়োজন থাকায় এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রায় পুরো মাসব্যাপী বান্দরবানে থাকছে নানা আয়োজন।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভিন্ন হলেও বাঙলা বর্ষপঞ্জির চৈত্র-বৈশাখ বা খ্রিস্ট বর্ষপঞ্জির এপ্রিল মাসের এই সময়টিতে নানা জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষের এমন উৎসবমুখীনতা পুরো বছরের সব দুঃখ ও না পাওয়ার বেদনাকে মুছে দিয়ে এক অপার্থিব আনন্দধারা ছড়িয়ে দেয় পাহাড়ের কন্দরে-কন্দরে জনপদে-জনপদে। যেদিকে চোখ পড়ে, বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে সবখানেই সাজ সাজ রব। বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট (কেএসআই) ৫ এপ্রিল থেকে উৎসবমালার আয়োজন করেছে।

পাহাড়ে বসবাসকারী ১১টি জাতিসত্তার মধ্যে বম, পাংখো এবং লুসাই জনগোষ্ঠীর সবাই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করায় এখন আর নববর্ষকেন্দ্রিক কোনো উৎসবের আয়োজন করেন না। তবে কেউ কেউ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেও মারমা জনগোষ্ঠী তাঁদের বর্ষ বিদায় ও বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে সাংগ্রাইং উৎসব, চাক জনগোষ্ঠী ‘সাংক্রাইং’ উৎসব, খুমি জনগোষ্ঠী ‘সাংক্রাইং’ উৎসব, খেয়াং জনগোষ্ঠী ‘সাংগ্রান’ উৎসব, ম্রো জনগোষ্ঠী ‘চাংক্রান’ উৎসব, চাকমা জনগোষ্ঠী ‘বিজু’ উৎসব, তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী ‘বিষু’ উৎসব এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী ‘বৈসু’ উৎসব এখনো ধরে রেখেছে।

বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-কেএসআই এসব উৎসব উপলক্ষে ১৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। কেএসআইর গৃহীত কর্মসূচির আওতায় ৫ এবং ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বর্ণিল এ উৎসবকে আবাহন জানানো হয়।

৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়েছে জৌ জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব ও পূজা-পার্বন বিষয়ক দিনব্যাপী কর্মশালা। এতে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের আগের উৎসব এবং ধর্মগ্রহণ পরবর্তী বর্তমান সময়ে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি বেশ জোরেশোরে ওঠে আসে।

এর বাইরে বান্দরবান উৎসব উদযাপন পরিষদের সাথে যৌথ উদ্যোগে কেএসআই ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা ও খুমিদের বর্ষবরণ উৎসবের আয়োজন করেছে। এর আগের বছরগুলোতে কেএসআইর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করলেও তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতি এবার নিজেদের একক উদ্যোগে বর্ষবরণ উৎসবের প্রস্তুতি নিয়েছে। ১২ এপ্রিল সন্ধ্যায় শহরের বালাঘাটা বিলকিস বেগম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তঞ্চঙ্গ্যা জনজাতির ঐতিহ্যবাহী ঘিলাখেলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে।

‘তঞ্চঙ্গ্যা জাতীয় গোল্ডকাপ ঘিলাখেলা টুর্নামেন্ট’ নামের এ প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং এমপি। উৎসব উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সচিব উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা জানান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় বসবাসকারী তঞ্চঙ্গ্যা নাগরিকরাও এই উৎসবে অংশ নেবেন।

এদিকে বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১১ এপ্রিল সকাল ৯টায় বান্দরবান-থানচি সড়কের চিম্বুক পাহাড় সংলগ্ন ভাইট্টাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ম্রো জনজাতির ‘চাংক্রান’ উৎসব উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও গো হত্যা নৃত্য অনুষ্ঠিত হবে।

কেএসআই এবং উৎসব উদযাপন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে ১৩ এপ্রিল সকাল ৮টায় বান্দরবান শহরের রাজার মাঠ থেকে মারমা জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব ‘সাংগ্রাইং পোয়েঃ’ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হবে। কেএসআই পরিচালক মং নু চিং জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন।

কর্মসূচি অনুযায়ী বাঙলা নববর্ষ উপলক্ষে ১৪ এপ্রিল সকাল ৭টায় রাজার মাঠ থেকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে। বাঙালি ছাড়াও পাহাড়ে বসবাসকারী মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমি, খেয়াং, চাক, বম, পাংখো এবং লুসাই জনজাতির সংস্কৃতিকর্মীরা নিজ নিজ ঐতিহ্যবাহী পোশাক নিয়ে সর্বজনীন এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন।

মারমা জনগোষ্ঠীর বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্ব ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ ও লোকজ খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হবে ১৫ এপ্রিল বিকেল ৩টায় রাজার মাঠে। পরের দিন ১৬ এপ্রিল বিকেল ৩টা রাজার মাঠে ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে।

১৬ এপ্রিল সকাল ৯টায় রোয়াংছড়ি উপজেলার সাংকিং পাড়ায় খুমি জনজাতির ‘সাংক্রাইং’ উৎসব, ১৮ এপ্রিল সকাল ৯টায় সদর উপজেলার রাজবিলা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মারমা বর্ষপঞ্জি ‘সাক্রয়-১৩৮০’ বর্ষবরণ উৎসব এবং ১৯ এপ্রিল সকাল ১০টায় রোয়াংছড়ি উপজেলার আন্তাহা ত্রিপুরা পাড়ায় ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ উৎসব আয়োজন করেছে কেএসআই।

এতে ত্রিপুরা বৈসু উপলক্ষে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্য পরিবেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন লোকনৃত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।

এদিকে বিভিন্ন পাড়া প্রধানের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সামর্থ্য সীমিত হলেও প্রতিটি জাতিসত্তার মানুষ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে বাড়ি-ঘর সজ্জিতকরণ এবং সাধ্যানুযায়ী গ্রামে গ্রামে উৎসবমালার আয়োজন করেছে।

পাঠকের মতামত: