ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বান্দরবানে ‘বৈসাবি’ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীতে বর্ণিল আয়োজন

বান্দরবান প্রতিনিধি :

বান্দরবানে আগামী ১৩এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীগুলোর ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের আমেজ। ইতিমধ্যে এলাকা ভিত্তিক নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে উৎসবকে বরণ করে নেওয়ার যাবতীয় আয়োজন।

ক্যায়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে এ উৎসব। বান্দরবানে জেলা ও উপজেলা সদর এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোর বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, ক্লাব, সমিতির উদ্যোগে সাংগ্রাইং পোয়ে জলকেলি উৎসব পৃথক ভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির নেতৃবৃন্দরা। উৎসবের দিনগুলোতে আনন্দে হয়ে উঠবে পাহাড়ি বাঙ্গালীর স¤প্রীতির এক মিলনমেলা। ১৩ এপ্রিল শুরু হয়ে উৎসব শেষ হবে ১৬এপ্রিল। শান্তিপূর্ণ বৈসাবি উৎসর পালনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ী-বাঙ্গালীর মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সু-দৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা এখন সকলের।

বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় বর্ষবরণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। ১৯৮৫ সাল থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব পালন করে আসছে। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ হিসেবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এ উৎসবকে সামনে রেখে উপজেলাগুলোর হাট-বাজারে কেনা-কাটা ধুম পড়েছে। বিপনী বিতানগুলোতে পাহাড়ি তরুন-তরুনীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষনীয়।

বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসবকে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈসুক’, মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা সম্প্রদায় ‘বিজু’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন। একত্রে ৩টি আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈ-সা-বি বলে পাহাড়ে এই উৎসব পরিচিত। চৈত্রের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু। এদিনে ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিন চৈত্র সংক্রান্ত ‘বৈসাবি’ অথবা মূল বিজু। এদিনকে উৎসবের প্রধান দিন ধরে নেয় চাকমারা। ত্রিপুরা ও মারমারা এদিন পালন করলেও তাদের জন্য ১ বৈশাখ হচ্ছে গুরুত্বপুর্ণ দিন। মূল বিজুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘পাচন’ (অনেক রকমের শাক-সবজি, ফল মুলের সমন্বয়ে রান্না করা তরকারি)। এই পাচনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এদিন নতুন কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি বেড়ানো, পাজন খাওয়া চাকমাদের আনন্দ উদ্যাপনের মূল আয়োজন। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, বিজুর দিন কমপক্ষে পাঁচ বাড়িতে বেড়াতে হবে। এসব বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাজন খেলে পরবর্তী ৩ মাস কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেনা কেউ। পাচনের সঙ্গে ভাত থেকে তৈরি পানীয় অর্থাৎ দো-চুয়ানী (বাংলা মদ)। এই দো-চুয়ানী ছাড়া চাকমা সমাজে বিজু, বিয়ের অনুষ্ঠান কখনও সম্পন্ন হয়না। এই রীতি এখানে প্রচলিত। আর এই দিন বাংলা মদ খেতে কোন বাধা নেই। খাও দাও অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। এটাই রীতি।

ত্রিপুরা সম্প্রদায় এদিন উদ্যাপন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ নাচের মাধ্যমে। যার নাম ‘গড়াইয়্যা নৃত্য’। নারী পুরুষ সবাই এক সঙ্গে নাচে। এ নাচের বিশেষত্ব হচ্ছে, যে বাড়ি থেকে এ নাচ শুরু হবে সে বাড়িতেই এসে নাচ শেষ করতে হবে। ত্রিপুরাদের এই উৎসবকে ‘বৈসুক’ বলে। মারমা সম্প্রদায় ১ বৈশাখ পালন করে বর্ণিল জলকেলী বা পানি উৎসবের মধ্য দিয়ে। পুরনো বছরের সব দুঃখ হতাশাকে মুছে ফেলার জন্য জল ছিটানো উৎসব (পানি খেলা)। যা মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব নামে পরিচিত। অবশ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাকমাদের সাংগ্রাই উৎসবের নাম এখন ‘ওয়াটার ফেষ্টিভ্যাল’ রাখা হয়েছে। নারী-পুরুষ মারমা গানের তালে তালে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে একে অপরকে জলে টুইটুম্বুর করে ভেজানোর প্রতিযোগিতা করেন। এই জলকেলির মাধ্যমে মারমা তরুন-তরুনী একে অপরের মাঝে ভালোবাসার বিনিময় করেন। একইভাবে ত্রিপুরা, বম, পাংখোয়া স¤প্রদায়গুলোও সাংস্কৃতিক অনুষ্টান ও নিজস্ব খাবারের আয়োজন করছে। বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় নানা খেলা-ধুলারও আয়োজন করা হয়েছে। এসব খেলার মধ্যে রয়েছে ঘিলাখেলা, নাদেরখেলা, বলিখেলা, ফোরখেলা, পুত্তিখেলা ও তুমুরো খেলা এবং তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠা। আয়োজক ও জনপ্রতিনিধিদের মতে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকুলে থাকায় এবার উৎসব মখুর পরিবেশে ‘বৈসাবি’ পালনে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

বান্দরবান বৈসাবি উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কো কো চিং মার্মা, এবারও উৎসব মখুর পরিবেশে বৈসাবি উদযাপিত হবে। বৈসাবিকে সামনে রেখে ৪ দিনের বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ক্যয়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনা, দড়ি টানাটানি, হাড়ি ভাঙ্গা, পিঠা তৈরি, ঐতিহ্যবাহী তৈলাক্ত বাঁশ আহরণ, পানি খেলা, সাংস্কৃতিক ও পুণর্মিলনী অনুষ্ঠান তবে বৈসাবি সবচেয়ে আকর্ষন হচ্ছে জলকেলি।

এ বিষয়ে জেলার পুলিশ সুপার জাকির হোসেন মজুমদার বলেন, পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ উৎসবকে ঘিরে শান্তিপূর্ণ ভাবে পালনের জন্য বৌদ্ধ কেয়াংগুলোতে আনসার ভিডিপি ও সাদা পোষাকে পুলিশ মোতায়েনসহ বিশেষ নজর রাখা হবে।

পাঠকের মতামত: