ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

ইয়াবা কারবারিদের মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব, মন্ত্রিসভায় উঠছে মাদকদ্রব্য আইনের খসড়া

নিউজ ডেস্ক ::
ভয়াবহ মাদক ইয়াবার বিরুদ্ধে অবশেষে কঠোর আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এতে ইয়াবা ব্যবসা তথা এটি মজুদ, বিক্রয়, পরিবহন ও সংরক্ষণ করলে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রথমবারের মতো সিসাকেও মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বিদ্যমান ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বিভিন্ন ধরনের মাদকের নাম থাকলেও ইয়াবার নাম ছিল না। ওই আইন যখন করা হয়, তখনও ইয়াবার প্রচলন হয়নি। তবে এরই মধ্যে ইয়াবার ছোবলে দেশের যুব সমাজের একাংশ ধ্বংস হতে চলেছে।

বিদ্যমান আইনে নির্দিষ্ট কিছু মাদকদ্রব্য জিম্মায় বা দখলে রাখা এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইয়াবা মাদক হিসেবে না থাকায় আইনের ফাঁকে আসামিরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আইনের দুর্বলতার কারণে ইয়াবা পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আইন প্রণয়ন করছে সরকার।

প্রস্তাবিত আইনে ইয়াবাকে ‘ক’ শ্রেণির তফসিলভুক্ত মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও চিকিৎসকদের মতে, ইয়াবা ট্যাবলেটে এমফিটামিন ও ক্যাফেইনের মতো যে মিশ্রণ রয়েছে- তা ‘ক’ শ্রেণির মাদক। অথচ বিদ্যমান আইনে ইয়াবা ট্যাবলেট মাদক হিসেবে তফসিলভুক্ত ছিল না। কেউ ২০০ গ্রাম ইয়াবা ট্যাবলেট বা ইয়াবার উপাদান সরবরাহ বা পরিবহন করলে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

নতুন আইনে সিসাকেও (বিভিন্ন ধরনের ভেষজের নির্যাস, নিকোটিন এবং এসেন্স ক্যারামেল মিশ্রিত ফ্রুট স্লাইস দিয়ে তৈরি পদার্থ) মাদকদ্রব্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ১৯৯০ সালের বিদ্যমান আইনে সিসাও মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ এই সিসায় আসক্ত হয়ে যুবক-যুবতীরা নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। অভিভাবক মহলেও দুশ্চিন্তা বেড়েছে। কেউ সিসা বহন কিংবা মজুদ করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকার জনস্বার্থে মাদকের ভয়াবহতা বিবেচনা করে রাষ্ট্রের যে কোনো অঞ্চলকে বিশেষ মাদকপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা দিতে পারবে। ফলে ওই অঞ্চলে মাদক অপরাধ সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল, লজিস্টিক ইত্যাদি যে কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমকালকে বলেন, ইয়াবার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইয়াবা মাদক হিসেব বর্তমান আইনে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনটি সংশোধন করে ইয়াবাকে ‘ক’ শ্রেণির মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ শাস্তি রাখা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। তবে শুধু শাস্তি দিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ জন্য মসজিদের ইমাম, গণমাধ্যম, শিক্ষক, আলেম, সমাজসেবক, এনজিও ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদকের আগ্রাসন ভিশন-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে অন্যতম অন্তরায়। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে দেশের বৃহৎ জনশক্তি যুব সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অথচ সমাজের কিছু অর্থলিপ্সু মানুষ যুব সম্প্রদায়কে ইয়াবা নেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদক আন্তর্জাতিক সমস্যা। এটা নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। মাদক প্রবেশ রোধে বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করা হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এরই মধ্যে আইনটি যুগোপযোগী করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ নাম দেওয়া হয়। মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ, সরবরাহ ও চাহিদা হ্রাস, অপব্যবহার ও চোরাচালান প্রতিরোধ এবং মাদকদ্রব্যের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের বিষয় নতুন আইনে সংযুক্ত করা হচ্ছে।

বিদ্যমান আইনের বিভিন্ন দিক আলোচনা করে সভায় বলা হয়, ইয়াবা পাচারকারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তবে এটি মাদক হিসেবে তফসিলভুক্ত না থাকায় ইয়াবায় মাদক এমফিটামিন ব্যবহূত হয়, এটা উল্লেখ করে বিদ্যমান আইনের ১৯ (১)-এর ৯(ক) ও ৯ (খ) ধারায় বিচার হয়ে আসছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ১৫ বছরের কারাদ। সংশ্নিষ্টদের মতে, আধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পার পেয়ে যায় ইয়াবা কারবারিরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হচ্ছে। এই আইনে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করেন তিনি। সচিব আরও বলেন, মাদকের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়। ধর্মীয় অনুশাসন, আচার-আচরণ, পারিবারিক বন্ধন মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। দেশের ৬৫ শতাংশ জনগণ কর্মক্ষম। তাদের কাজে লাগাতে না পারলে সরকারের রূপকল্প অর্জন সম্ভব নয়।

ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে কঠোর আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন মাদকবিরোধী আন্দোলনের নেতারা।

মাদকবিরোধী সংগঠন মানসের প্রধান ড. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, মাদক ব্যবহারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। এর নেপথ্যে রয়েছে মাদক গডফাদাররা। তারা যাতে আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে না যেতে পারে সেটি খেয়াল রেখে গডফাদারদের আটকের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি থাকবে। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সদস্য থাকবেন অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, ধর্মমন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দ, পুলিশপ্রধান, সরকার মনোনীত বিশিষ্ট সাংবাদিক, সমাজসেবকসহ ৩৮ সদস্য। এই কমিটি মাদকদ্রব্যের আমদানি, রফতানি, উৎপাদন, বিপণন, সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে অনুমোদন দেবে। অধিদপ্তরের প্রণীত কর্মকৌশল, সুপারিশ ও নীতিমালা অনুমোদন দেবে জাতীয় কমিটি।

প্রস্তাবিত আইনে আরও বলা হয়েছে, আইনের উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে সরকার দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় চুক্তি, কনভেনশন বা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত অন্য কোনোভাবে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করতে পারবে।সত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত: