ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আবাদি জমিতে হাতির রাজত্ব

হাতির তাণ্ডব ধেকে ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার পাহাড়ি এলাকায় এভাবে গাছে মাচাং (টংঘর) বেঁধে পাহারা দেন কৃষক।

 নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্রগ্রাম ::

সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় লোকালয়ে চলছে বন্যহাতির রাজত্ব। দুই উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় তিন হাজার একরের অধিক আবাদি জমি এখন বন্যহাতির দখলে। আবাদযোগ্য এসব জমি এখন হাতির বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রায়ই লোকালয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে বেপরোয়া বন্যহাতির দল। তছনছ করে দিচ্ছে বসতঘর, গাছপালা ও মাঠভরা ফসল এবং ঘটছে প্রাণহানি।

গত ১০ বছরে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় হাতির আক্রমণে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ফলে লোকসান এবং প্রাণের ভয়ে জমিগুলোতে কৃষকরা চাষাবাদ বন্ধ করে দিয়েছে। এক সময় শুধু ধান পাকার মৌসুমে লোকালয়ে আসত বন্যহাতির দল। এখন ঘুরে ফিরে সারা বছরই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে ক্ষিপ্ত হাতির দল। ধানে শীষ আসা থেকে শুরু করে পাকা পর্যন্ত সময়ে লোকালয়েই যেন হাতির মূল আবাসস্থল! হাতির খাবারের জন্যই যেন কৃষকরা ফসল আবাদ করছে! ফলে এসব এলাকার কৃষকরা হাতির কাছ অসহায় আত্মসমর্পণ করছে।

নিজের বাপ-দাদার রেখে যাওয়া আবাদি জমি এখন হাতিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে বন বিভাগ ও হাতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ হাতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে বলেই হাতি মানুষের জায়গা দখল করছে। এতেই বাড়ছে ‘হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব’। খাবার ও নিরাপদ আবাসযোগ্য স্থান সংকটের কারণে হাতি বন ছেড়ে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। বিশেষ করে চলাচলের পথে পরিবর্তনের ফলে হাতি বেশি ক্ষিপ্ত আচরণ করছে। মানব সৃষ্ট কিছু কারণে হাতি মানুষকে শত্রু মনে করছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন কারণে হাতি একটু বেশি অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সরেজমিন পরিদর্শন, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাতকানিয়ার ছদাহা, বাজালিয়া, সোনাকানিয়া, মাদরাসা, এওচিয়া, কাঞ্চনা, চরতি, পুরানগড়, লোহাগাড়ার পদুয়া, বড়হাতিয়া, চুনতি, আধুনগর, চরম্বা, কলাউজান ও পুটিবিলা এলাকায় শুধুমাত্র বন্যহাতির কারণে ৩ হাজার একরের অধিক আবাদি জমি অনাবাদি পড়ে রয়েছে। এসব জমিত আগে আমন, বোরোচাষ ছাড়াও মৌসুমি শাক-সবজির চাষ হত। কোনো কোনো বছর শুধু ধান পাকার মৌসুমে বন্যহাতির দল লোকালয়ে হানা দিত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই বন্যহাতির দল লোকালয়ে ছুটে আসছে। এ সময় হাতি কাঁচা-পাকা ধান, মৌসুমি শাক-সবজি খেয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। ভাঙচুর করছে বসতঘর। আর বাধা দিতে গেলেই ঘটছে প্রাণহানি।

সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ইউনিয়নের সাইরতলী এলাকার কৃষক আলী আহমদ ও হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা বাপ-দাদার আমল থেকে যেসব জমিতে চাষাবাদ করে আসছি সেগুলো এখন হাতির দখলে। এসব জমিতে আমরা নিয়মিত চাষ করতাম। পুরো বছরে দু-একবার গভীর রাতে বন্যহাতির দল লোকালয়ে আসত। ধান খেয়ে সকাল হওয়ার আগে আবার বনে ফিরে যেত। ওই সময়ে কৃষকরা পাহাড়ি এলাকায় ধানক্ষেত পাহারা দেওয়ার জন্য রাতে উঁচু গাছের মগডালে মাচাং (টংঘর) বেঁধে টর্চলাইট ও আগুন জ্বালানোর নানা সরঞ্জাম নিয়ে অবস্থান করত। হাতির দল পাহাড় থেকে নামতে দেখলে মশাল জ্বালিয়ে চিৎকার দেওয়া হতো। তখন হাতি পুনরায় বনে ফিরে যেত। এভাবে কিছুদিন রাতের বেলায় পাহারা দিলে ধানক্ষেত রক্ষা করা যেত। কিন্তু এখন মশাল জ্বালিয়ে কাজ হয় না। এখন আর দিন রাত ভাগ নেই। যখন ইচ্ছা তখন এসে ধান খেয়ে ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে চলে যায়। এভাবেই সারা বছর চলে হাতির অত্যাচার। ফলে পাহাড়ি এলাকার জমিগুলোতে এখন আর চাষাবাদ করি না। পুরো বছর জমির ধারে কাছেও যায় না। এসব জমি এখন হাতির দখলে।

সাতকানিয়ার এওচিয়ার ছনখোলা এলাকার রফিক আহমদ ও নুরুল কবির নামের দুজন কৃষক বলেন, বন্যহাতির কাছে কৃষকরা এখন বড় অসহায়। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে সারা বছরই হাতি আসছে। ফলে এসব এলাকায় ধান চাষ করলে কৃষকদেরকে ধান কাটার জন্য জমিতে যেতে হয় না। এর আগে সব ধান খেয়ে তছনছ করে দেয় হাতির দল। তবুও কিছু কিছু কৃষক সাহস করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধানচাষ করে। ধানে শীষ আসার পর থেকে হাতি খেতে শুরু করে। পুরোপুরি পাকার আগে হাতির খাওয়া শেষ হয়। নানা কৌশলে ধান পাহারা দিতে গিয়ে বন্যহাতির পায়ের নিচে গেছে অনেক জীবন। ফলে কৃষকরা এখন চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একদিকে মৃত্যুর ভয়, অন্যদিকে বছরের পর বছর লোকসান। ফলে পাহাড়ি এলাকার জমিগুলো এখন সারা বছর অনাবাদি থাকছে। লোহাগাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শামীম হোসেন জানান, বন্যহাতির দল এখন সারা বছরই লোকালয়ে হানা দিচ্ছে। এসময় হাতির দল ধান, মৌসুমি শাক-সবজি খেয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। ফলে কৃষকরা পাহাড়ি এলাকার আবাদি জমিগুলোতে এখন আর চাষ করছে না। যেসব কৃষক সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে চাষ করছে তারাও প্রতিবছর ক্ষতির শিকার হচ্ছে। জমি থেকে ধান কেটে আনতে পারাটা ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকের কষ্টে উত্পাদিত ধান হাতির পেটে যাচ্ছে। ধান ও মৌসুমি সবজি ক্ষেত পাহারা দিতে গিয়ে হাতির আক্রমণে অনেক কৃষক প্রাণ হারিয়েছেন। বিশেষ করে পদুয়া, বড়হাতিয়া, চুনতিতে পাহাড়ের কাছাকাছি জমিগুলোর বেশির ভাগ অনাবাদি পড়ে থাকে।

লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এমডি জুনাইদ চৌধুরী জানান, গত এক বছরের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই বন্যহাতি লোকালয়ে এসেছে। বিশেষ করে বড়হাতিয়ার ঘোনারমোড়, কুমিরাঘোনা, হরিদারঘোনা, হোসেননগর এলাকায় সারা বছরই বন্যহাতি তাণ্ডব চালিয়েছে। হাতির পেটে গেছে কৃষকের উত্পাদিত ফসল। শুধুমাত্র হাতির ভয়ে বড়হাতিয়ার প্রায় ৫ শত একর আবাদযোগ্য জমি অনাবাদি রয়েছে। এবছর বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে ২টি হাতি মারাও গেছে।

পদুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জহির উদ্দিন জানান, জঙ্গল পদুয়া এবং হরিদারঘোনা এলাকায় হাতির ভয়ে চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। কৃষকরা অনেক কষ্ট করে চাষ করত। হাতি এসে খেয়ে সব তছনছ করে দিত। এভাবে চলতে চলতে কৃষকরা এখন আর এসব জমিতে চাষাবাদ করে না। চেয়ারম্যানের দেওয়া তথ্যমতে, এসব এলাকায় প্রায় ৪ শত একরের অধিক জমিতে এখন আর লাঙল চলে না। এসব জমি এখন হাতির দখলে।

সাতকানিয়ার ছদাহা ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোসাদ হোসেন চৌধুরী জানান, পূর্ব ছদাহা, সন্দীপ্যাপাড়া, নয়াপাড়া, উত্তর ছদাহা, হরিণতোয়া, বনামুড়া, ছহিরপাড়া, খন্দকারখীল ও সাঁড়াশিয়া এলাকায় বছরের বেশির ভাগ সময় বন্যহাতি থাকে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে কৃষকরা পাহাড়ের নিকটবর্তী আবাদি জমিগুলো অনাবাদি ফেলে রেখেছে। এসব এলাকায় ধান ও সবজি চাষ করে বছরের পর বছর লোকসান দিতে দিতে কৃষকরা এখন চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ছদাহায় প্রায় ৫০০ একরের অধিক জমি শুধু হাতির ভয়ে অনাবাদি পড়ে থাকে।

এওচিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিক জানান, হাতির ভয়ে শুধুমাত্র ছনখোলা এবং চুড়ামনি এলাকায় কমপক্ষে ৫ শত একর জমি অনাবাদি রয়েছে। এখানে চাষ করে কৃষকরা রাত জেগে পাহারা দিয়েও ফসল ঘরে তুলতে পারে না। সব হাতির পেটে চলে যায়। ফলে এসব জমি এখন অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চুনতি অভয়ারণ্য রেঞ্জের এক কর্মকর্তা জনান, চুনতি অভয়ারণ্যের প্রধান বনজদ্রব্য হচ্ছে বাঁশ। এ জায়গা হাতির প্রজননের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। অভয়ারণ্য এলাকায় এ বছর ৬টি হাতির বাচ্চা জম্ম হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে ৬৪-৬৫টি হাতি রয়েছে। প্রজননের সময় হাতির সংখ্যা বেড়ে যায়। এ সময় ২-৩ শ’ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা হাতিগুলো চুনতি অভয়ারণ্যে চলে আসে। বিশেষ করে পার্বত্য জেলা বান্দরবান এবং টেকনাফ এলাকায় থাকা হাতি প্রজননের সময় এখানে চলে আসে। এখানকার হাতিও বান্দরবান এবং টেকনাফে যায়। আর হাতির হোম রেঞ্জ হল দেড় শত কিলোমিটার। প্রত্যেকটি হাতি দৈনিক দেড় শ থেকে দুই শ কিলোমিটার চলাচল করে। কিন্তু অভয়ারণ্যের দূরুত্ব হাতির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে বাধ্য হয়ে হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। অভয়ারণ্য ছাড়াও যেখানে কম বেশি পাহাড়ি এলাকা রয়েছে সেখানে চলে যায়।

তিনি আরো জানান, হাতির জায়গা মানুষ দখল করে নিচ্ছে। হাতি মানুষের জায়গা দখল না করলে কোথায় যাবে। পাহাড়ের সন্নিকটে হাতি চলাচলের নিজস্ব কিছু পথ রয়েছে। আর মানুষ সেখানে খেয়াল খুশি মতো কাজ করছে। চলাচলের পথে পরিবর্তন হাতি কোনোভাবে সহ্য করবে না। পরিবর্তন হচ্ছে বলে মানুষের সঙ্গে হাতির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে হাতি ঘরবাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি মানুষ মারছে। এছাড়া পাহাড়ে হাতির খাদ্যের সংকট রয়েছে। বিগত ৮-১০ বছর যাবৎ বন্যপ্রাণীর খাবার উপযোগী গাছ রোপণ করা হয়নি। ফলে খাদ্য সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখন পশুখাদ্যের উপযোগী কিছু বাগান করা হচ্ছে। এসব গাছ বড় হলে পাহাড়ে হাতির খাদ্য সংকট কিছুটা কমবে।

তিনি জানান, লোকালয় থেকে হাতি তাড়ানোর নির্দিষ্ট কিছু কৌশল আছে। লোকজনের সে বিষয়ে ধারণা না থাকাতে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাচ্ছে। কোন এলাকা দিয়ে হাতি লোকালয়ে এসেছে সেটা চিহ্নিত করে সেদিক খোলা রেখে অন্য তিন দিক থেকে আওয়াজ করে, ঢোল পিটিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানো যায়। তবে তা সতর্কতার সাথে করতে হবে। হাতি এলাকায় আসার পথ চিহ্নিত না করে চার দিক থেকে এক সাথে আওয়াজ করলে, ঘিরে ধরলে বা অন্যভাবে তাড়ানোর চেষ্টা করলে হাতি ক্ষিপ্ত হয়ে লোকজনের ক্ষতি করবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাজী আছমত জানান, পাহাড়ে খাবার ও বাসযোগ্য স্থানের সংকট সৃষ্টি হওয়ায় হাতিগুলো বন ছেড়ে লোকালয়ে আসছে। আগে পাহাড়ে হাতির পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার ছিল বলেই লোকালয়ে আসত না। শুষ্ক মৌসুমে লতা-পাতা কম থাকলে লোকালয়ে আসত এবং ধান আর সবজি খেয়ে চলে যেত। কিন্তু এখন পাহাড়ে সারা বছরই হাতির খাদ্য সংকট থাকে। ফলে হাতিগুলো ঘুরে ফিরে লোকালয়ে চলে আসে। পেটে ক্ষুধা থাকলে কিছুই মানবে না। পাহাড়ে অধিক হারে প্রাণী খাদ্যের উপযোগী বাগান করা গেলে খাবার সংকট কিছুটা নিরসন হত। তখন হাতি লোকালয়ে কিছুটা হলেও কম আসত।

পাঠকের মতামত: