ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

তামাকের আগ্রাসনে উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রতিবছরের মতোই এবারও জমি দখল করে নিয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের আগ্রাসন। তামাক আবাদ বন্ধে ইতোপূর্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উপরন্তু দিন দিন এখানে আগ্রাসন বাড়ছে তামাকের। আবার মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের সরকারি খাস জমিতেও ব্যাপকভাবে চাষ হয়েছে তামাকের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারিভাবে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন অবস্থাতেই তামাক চাষ বন্ধ করা যাবে না। কেননা তামাক চাষে পরিবেশ, চাষীসহ পরিবার এবং আশপাশের মানুষের শারিরীক ক্ষতি হলেও কোম্পানীগুলোর লোভ দেখানো ফাঁদে পড়ে তামাক আবাদের দিকেই ঝুঁকছে চাষিরা। এতে প্রতিবছরই বাড়ছে তামাকের পরিধি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চকরিয়ায় কম করে হলেও প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে এবারও চাষ হয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের। আর এসব তামাক শোধন করতে গিয়ে হাজারো চুল্লিতে জ্বলছে বনের কাঠ। এতে আরো বেশি উজাড় হয়ে যাচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান। ব্যক্তি মালিকানাধীন কৃষি জমির পাশাপাশি তামাক আবাদের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও মাতামুহুরী নদীর দুই তীরে জেগে উঠা খাস জমিতে। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে চকরিয়া উপজেলার বমুবিলছড়ি ইউনিয়নের বমু বনবিট ও সুরাজপুর–মানিকপুর ইউনিয়নের মানিকপুর বনবিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এবং উপজেলার মাতামুহুরী নদী তীরের বমু বিলছড়ি, সুরাজপুর–মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, বরইতলী ও চিরিঙ্গা ইউনিয়নের বিপুল পরিমাণ খাস জমিতে তামাক চাষ চলছে।

জানা গেছে, সরকারি হিসেবে উপজেলায় আগের চেয়ে কম পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে বলে কৃষি বিভাগ দাবি করলেও বাস্তবে দেখা গেছে তামাক চাষের পরিধি গতবছরের চেয়ে এ বছর বেড়ে গেছে।

তামাক চাষের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে জড়িত এনজিও সংস্থা উবিনীগ ও একলাবের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চকরিয়ায় উপজেলায় প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। একই সাথে বনাঞ্চলের আশপাশে ও লোকালয়ে কয়েক হাজার তামাক চুল্লির নির্মাণকাজও চলছে। বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ঢাকা টোব্যাকো, ও রাঙ্গুনিয়া সমিতিসহ অসংখ্য তামাক কোম্পানী চাষিদের প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে মাঠে নামিয়েছে।

সংস্থা দুটির গবেষণা কর্মকর্তাদের ধারনা, টোবাকো কোম্পানীগুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে কৃষকরা প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে এ বছর তামাকের চাষ করেছে। প্রতিবছর তামাক চাষের পরিধি বাড়তে থাকায় উপজেলার আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে করে চরমভাবে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে এ উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে বলে দাবি করেছেন কৃষি সচেতন মহল।

জানতে চাইলে তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বেসরকারী সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) কক্সবাজারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছর চকরিয়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার একর জমিতে তামাকের আগ্রাসন চলছে। তন্মধ্যে সংরক্ষিত বনের কিছু অংশ এবং মাতামুহুরী নদীর দুই তীরের খাস জমি মিলিয়ে আরো এক হাজার একর জমিতে তামাকের আবাদ শুরু হয়েছে। তামাক কোম্পানীগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা চাষিদেরকে প্রলোভনে ফেলে দীর্ঘদিন ধরে এখানে তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। এমনকি বিনাসুদে ঋণ দেওয়া ছাড়াও তামাক ক্রয়ের সময় ভাল দাম দেওয়ার কথা বলায় প্রতিবছর পরিবেশ বিধ্বংসী এ চাষে সম্পৃক্ত করছেন চাষীদেরকে।’

জানা গেছে, উপজেলার সুরাজপুর–মানিকপুর, কাকারা, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাসিয়াখালী, কৈয়ারবিল ও বরইতলী ইউনিয়নে এবং পৌরসভার আংশিক এলাকায় গত এক দশক ধরে ফসলি জমিতে ভয়াবহ তামাকের আগ্রাসন ছড়িয়ে পড়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নীরবতার সুযোগে প্রতিবছর এখানে বেড়ে চলছে তামাক চাষের পরিধি। প্রতিবছর তামাক চাষের ভয়াবহ বিস্তারের কারণে উপজেলার এসব ইউনিয়নে হ্রাস পাচ্ছে আবাদি জমির পরিমাণ। এতে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে আগামীতে এ অবস্থা বিদ্যমান থাকলে উপজেলায় চরম খাদ্য ঘাটতি হবে।

বিগত সময়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তামাক চাষ অধ্যুষিত এলাকার লোকজনের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। এতে করে এলাকার পরিবেশও চরমভাবে বিষিয়ে উঠেছে।

চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম সভাপতি মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, ‘তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক র‌্যালি, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। কিন্তু প্রশাসনের এই কার্যক্রম এখন তামাক কোম্পানীর দাপটে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে অতীতের মতো এবছরও উপজেলায় বেড়েছে তামাকের আগ্রাসন। পাশাপাশি তামাক শোধনের জন্য চলছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও ব্যক্তি মালিকানাধীন গাছ নিধনের প্রস্তুতি।

পাঠকের মতামত: