ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

উন্নয়নের সাথে দুর্নীতির সহাবস্থান(!)

:: শহিদ রাসেল ::

ব্রিটিশ দার্শনিক ও বিশিষ্ট গণিতবিদ বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ‘ক্ষমতা মানুষকে নীতিহীন করে, চমর ক্ষমতা চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ করে’। প্রাজ্ঞজন তাঁর উক্তিতে যা বলেছেন, এখন সর্বত্র তার প্রমাণ মিলছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনে শত্রুর সাথে আপস করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে জনমনে ভীতির সঞ্চার করা হচ্ছে, মুখে নীতিবাক্যের উপন্যাস রচনা করলেও আসন ছাড়তে সবাই নারাজ। যেন ছলে-বলে কৌশলে ক্ষমতায়নই আসল কথা, বাকি সব বৃথা/মিথ্যা বুুলি! ক্ষমতার লোভ মানুষকে যন্ত্রে পরিণত করে। আর যান্ত্রিক মানসিকতায় যে কোনো ধরনের কাজে অংশগ্রহণ বা নির্দেশ দেয়া যায়। কিন্তু সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলোÑ যখন উন্নয়নকে দুর্নীতির সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। যখন দৃঢ়ভাবে দাবি করা হয়, ‘উন্নয়ন করতে হলে দুর্নীতি তো থাকবেই’ তখন আমাদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ ঘণ্টা বাজে।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যা পৃথিবীর বুকে স্বাধীনতার জন্য বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহ ’সহ ১৯৫২, ১৯৭১ সালের ভাষা ও মুক্তির সংগ্রাম এই দেশকে এনে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। এমন কোনো দেশ খোঁজে পাওয়া যাবে না যারা বর্তমান বাংলাদেশকে জানে না বা এই দেশের অগ্রগতিতে অভিবাদন/ঈর্ষান্বিত নন। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরই ক্রমবিকশিত এবং উন্নতির পথে ধাবমান। আর এই দেশের সবচেয়ে অবাক করার বিষয়টি হলো ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট’। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যে দলই ক্ষমতায় থাকুকনা কেন? বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাকে আর থামানো যাবেনা। যেমন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সোপান থেকে কাউকে আটকে রাখা যায়না। একদিন আমরা উন্নত দেশের কাতারে মাথা উঁচু করে যুগোপযোগী জীবনমান’সহ বিশ্বের দরবারে নেতৃত্ব দেবো- এই আশাবাদ আমাদের সকলের। আর আমাদের এই স্বপ্ন-সাধনার বাস্তব রূপায়ন জোরালোভাবে নির্ভর করছে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর। অথচ আমরা কখনো চলার পথে পাথেয় হিসেবে নৈতিক ভিত্তিকে গ্রহণ করছি। আমরা কেবল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাকে প্রধানতম ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করি যা আমাদেরকে অনৈতিকভাবে চালিত করে।

পুরো দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন চিত্র দেখে কেউ চিন্তাও করতে পারবেননা আমাদের দেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় অন্যতম(!) স্থান দখল করে আছে। আরো অবাক করার মতো বিষয় হলোÑ ক্ষমতাবানদের ‘দুর্নীতি’কে স্বীকৃতি/প্রশ্রয় দেয়ার মানসিকতা। তাঁদের মতে, উন্নয়ন করতে হলে দুর্নীতি থাকবেই। দুর্নীতিকে প্রতিহত করে উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে অনেকে বিরাট বিরাট যুক্তি দেখান। বস্তুত: যুক্তি দেখানোই শেষ কথা নয়। বক্তারা সবসময় নিজেদের স্বপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে পার পেয়ে যান। তাই কেউ কেবল যুক্তি দেখানোর মাধ্যমে অন্যায়-অনিয়মে পার পেয়ে যাবেন, তা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

বিচারের মুখোমুখি হওয়া, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহায়তা করাই হলো একজন সচেতন নাগরিকের অনুগত দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি খুবই করুণ, এক্ষেত্রে ‘তাল গাছটি আমার’ বিচারেই সবাই বিশ্বাসী। তার মানে আমরা ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে চরমভাবে উদাসীন। যে অন্যায়/অযাচিত আচরণটি আমি করছি ভবিষ্যতে ওই আচরণের জন্য আমি কি প্রস্তুত? উত্তর যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে তবেÑ ‘মহাশয়, আপনি চালিয়ে যান’।

অন্যদিকে, প্রশাসনিক দক্ষতা ছাড়া কোনো পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা অফিস-আদালত সঠিকভাবে চলতে পারেনা। নিয়মানুবর্তিতা প্রতিষ্ঠা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার যথার্থ মূল্যায়ণ করা না গেলে আমরা কখনোই ¯্রােতস্বিনী কর্মবাজারে টিকে থাকতে পারবোনা। মনে রাখতে হবে, ক্ষণিকের বাহ্বা/তোষামুদে স্লোগানে গদগদ হয়ে আপনি নিজের পিট নিজে চাপড়ালেও আপনার সম্পর্কে জনমনে যে হীন ধারণা জন্মাবে তা কখনো দূর করা যাবেনা। পদবীর ভিত্তিতে ক্ষমতা ও স্বাধীনতা দেয়া না হলে কোনো ব্যক্তিই তার সর্বোচ্চটা দিতে পারেননা। তাছাড়া দায়িত্ব বন্টনের ক্ষেত্রে আপনাকে অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে।

আপনার নিজস্বতাকে অন্য কেউ যেন চালিত করতে না পারেন সেদিকটি ভালো মতো খেয়াল রাখতে হবে। কর্মজীবনে প্রত্যেকের একটি নির্দিষ্ট শাসনকাল থাকে, ওই সময়টি যারা জবাবদিহিতার সাথে দায়িত্বরত থাকেন, তারা পরবর্তী কাল তথা অবসর জীবনটি বেশ উপভোগ করতে পারেন। পরিতাপের বিষয় হলো, যারা নিজেদের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কেবল নিজের আসন/পদবী টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে কর্মক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন তাঁদের অবসর জীবনটা অভিশাপে পূর্ণ থাকে। অবসরকালে ওই অভিশপ্ত জীবনে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একাকীত্বে কেবল বেঁচে থাকেন, যেখানে জীবনের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট থাকেনা। সম্পত্তির পাহাড় গড়া আর সুখী জীবনের অধিকারী হওয়া এক কথা নয়।

অফিসিয়াল শৃংখলা প্রতিষ্ঠা ও নিয়ম-নীতিতে অটল থাকাটা একজন দক্ষ প্রশাসকের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিদিনের কার্যদিবস ঠিকমতো শুরু ও শেষ করা, অফিসিয়াল কার্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করা, পরবর্তী দিনের কাজের জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখা দক্ষ প্রশাসনের নিত্য কাজ। আর যারা দিনের কাজ দিনে শেষ করতে পারেননা, অফিস-আওয়ার মেইনটেইন করতে প্রতিদিন হিমশিম খাওয়া, নিজের দায়িত্বভার বহনে অযোগ্যতা, কেবল চেয়ার টিকিয়ে রাখতে ‘লিমিটক্রস’ তোষামুদে মত্ত থাকেন, স্ট্যাটাস/লেবেল মেইনটেইন করতে না জানা, এছাড়া অর্পিত দায়িত্বের বাইরে কাউকে আদেশের বাণে জর্জরিত করাটা খুবই অবিবেচক।

সাধারণত: প্রতিষ্ঠানের নিয়ম রক্ষার কথা বলে কর্তাব্যক্তিরা সাধারণ চাকরিজীবীদের অধিকার ভক্ষণ করেন। তবে যাদের শক্ত লিংক/লবিং আছে কিংবা যারা তোষামুদে স্বভাবের তাদের জন্য ‘সব নিয়ম মাফ’। অন্যদিকে, ভেজাল সনদপত্র দিয়ে চাকরি করার গুরুতর অভিযোগ উঠছে। এসব প্রতিহত করতে না পারলে আমাদের জাতি অচিরেই মেধাশূণ্য হবে। তাই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী ‘মনিটরিং টিম’ এবং ওই টিমের কার্যকর উদ্যোগ আমাদেরকে আশার আলো দেখাতে পারে। ‘যোগ্য লোকের মূল্যায়ন হোক, অযোগ্যতার বিচার হোক’ এই স্লোগানটি ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে।

লেখক : শহিদ রাসেল

দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ংযধযরফৎঁংংবষ১৯৭১@মসধরষ.পড়স

পাঠকের মতামত: