ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

পাসপোর্ট অফিসগুলোতে ধাপে ধাপে ফাঁদ

অনলাইন ডেস্ক ::

রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গত বুধবার নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী পাসপোর্ট তুলতে এসেছিলেন আরিফ হোসেন নামের এক আবেদনকারী। এসে জানতে পারেন তাঁর পাসপোর্ট আসেনি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ডাক্তার দেখাতে ভারতে যাব। জরুরি ফি জমা দিয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেছি। আট দিন চলে গেছে, এখনো পাসপোর্ট হাতে পেলাম না। কী সমস্যা হয়েছে কার কাছে জানব, তা-ও বুঝতে পারছি না।’

নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট হাতে না পেলেও আরিফ ‘কিছুটা ভাগ্যবান’ যে আবেদন জমা দিতে পেরেছিলেন। কেননা ঢাকার বাইরের পাসপোর্ট অফিসগুলোর অবস্থা আরো বাজে। রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসে কয়েক দিন ঘুরেও আবেদন ফরমই জমা দিতে পারেননি রাজশাহী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীর আলম।

বাগমারা উপজেলার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর জানান, আবেদনের সব কাগজ ঠিকঠাক জমা দেওয়ার পরও কখনো বলা হচ্ছে আঠা ঠিকমতো লাগানো হয়নি, কখনো বলা হচ্ছে ছোট হাতের স্থলে বড় হাতের অক্ষরে লেখা হয়েছে ইত্যাদি। তৃতীয়বারের মতো গত বুধবার পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে গিয়ে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে।

জাহাঙ্গীর বলেন, ‘যারা দালাল ধরে টাকা দিচ্ছে তারা ঠিক এক দিনেই পাসপোর্টের কাগজপত্র জমা দিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু আমারটা জমা নেওয়া হচ্ছে না টাকা না দেওয়ায়।’

নানা দরকারে বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রাথমিক যে অনুষঙ্গ সেই পাসপোর্ট পেতেই ধাপে ধাপে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সেবাগ্রহীতাদের। দেশের সব পাসপোর্ট অফিসেই কমবেশি একই রকম ভোগান্তি। পাসপোর্ট ফরম জমা থেকে শুরু করে ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ দেওয়া, নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট পাওয়া—কোনো সেবাই ঠিকমতো পান না বেশির ভাগ আবেদনকারী। সেই সঙ্গে পুলিশ প্রতিবেদন (পিভিআর) পেতে পুলিশকে ঘুষ দেওয়া তো নিত্যসঙ্গী। আর অফিস ঘিরে গড়ে ওঠা দালালচক্রের ফাঁদ তো রয়েছেই। দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারাই বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে দালালরাই।

এমনকি পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সব কাজ শেষ হলেও সার্ভারের দুর্বলতায় পাসপোর্ট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বলে অভিযোগ সেবাগ্রহীতাদের। কয়েকটি পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে।

ঢাকার পাসপোর্ট অফিস : ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ওমর ফারুক সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে দেখেছেন আগারগাঁওয়ে থাকা পাসপোর্ট অফিস। সেখানে অফিসের ভেতরে ভোগান্তি কমার চিত্র দেখা গেলেও বাইরে দালালদের দৌরাত্ম্য ছিল ঠিকই।

গত বুধবার প্রধান সড়ক থেকে এই পাসপোর্ট অফিসের রাস্তায় ঢুকতে তিন-চারজন দালাল এ প্রতিবেদককে ঘিরে ধরে। তারা প্রত্যেকেই পাসপোর্ট করে দিতে চায়। এর মধ্যে একজন জানায়, তাকে ২০০ টাকা দিলেই পাসপোর্ট করে দেবে। আরেকজনের দাবি এক হাজার টাকা। এই টাকা দিলে দুই দিনে পাসপোর্ট হাতে পাইয়ে দেবে বলে জানায়। কিভাবে সম্ভব জানতে চাইলে এই দালাল বলে, ‘ভেতরে আমাদের লোক আছে। তারা দুই দিনে করে দেবে।’

ভোগান্তি কমানোর বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্টের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আসে ব্যাংকে পাসপোর্টের ফি জমা দিতে গিয়েও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আমি বলব, অতিদ্রুত পাসপোর্ট ফি জমা দিতে হলে ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকে জমা দেওয়া যেতে পারে। এসব ব্যাংক অনলাইন হওয়ায় যেকোনো ব্রাঞ্চে সহজে ফি জমা দেওয়া যায়।’

ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান বলেন, ‘পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ভোগান্তি অনেক কমেছে। যখন হজ মৌসুম আসে এবং কোনো দেশে লোকবল নেওয়ার ঘোষণা আসে তখন পাসপোর্টের চাপ অনেক বাড়ে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাঁরা অনলাইনে আবেদন করছেন তাঁরা সহজে পাসপোর্ট করতে পারছেন।’

মহাপরিচালকের কথার সত্যতা পাওয়া গেল বুধবার দুপুরে পাসপোর্ট হাতে পেয়ে হাসিমুখে বের হওয়া রুমা নামে ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর কাছ থেকে। তিনি জানান, ‘অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন জমা দিয়েছি। আজ এসে পাসপোর্ট নিয়ে গেলাম।’ জরুরি ফি দিয়ে ছয় দিনে তিনি পাসপোর্ট পেয়েছেন বলে জানান।

চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিস :  চট্টগ্রাম অফিসের প্রধান জানান, সেবাগ্রহীতার ভোগান্তি কমাতে সরকার চট্টগ্রামে পাসপোর্টের আবেদন জমা ও পাসপোর্ট গ্রহণের সুবিধার্থে বিভাগীয় ও আঞ্চলিক নামে দুটি অফিস চালু করেছে। এর পরও ভোগান্তির অভিযোগের কমতি নেই এই দুই অফিসকে ঘিরে।

আড়াই বছরের শিশুপুত্রের চিকিৎসায় ভারতে যাওয়ার জন্য পাঁচলাইশ আঞ্চলিক অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে নানা ভোগান্তির শিকার হন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী জানে আলমের স্ত্রী রেহেনা আকতার। তিনি অভিযোগ করেন, ছেলের জন্য গত ১১ ডিসেম্বর পাসপোর্টের আবেদন জমা দেন তিনি। গত ১ জানুয়ারি এটি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই তারিখে এসে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শেষে জানতে পারেন পাসপোর্ট আসেনি। এর সপ্তাহখানেক পর আবার গিয়েও পাসপোর্ট পাননি তিনি।

রেহেনা জানান, এরপর অফিসের একজন কর্মচারীর পরামর্শে তিনি স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করেন। থানা থেকে জানানো হয় এ ধরনের কোনো কাগজপত্র তারা পায়নি। গত ১৫ জানুয়ারি আবারও পাসপোর্ট অফিসে ধরনা দিয়েও এর কোনো সদুত্তর পাননি রেহেনা। অথচ তাঁর সঙ্গে একই দিন দালালের মাধ্যমে জমা দেওয়া এক আত্মীয়ের পাসপোর্টটি যথাসময়ে পেয়ে গেছেন বলে জানান তিনি।

রেহেনার মতো শত শত আবেদনকারী এ অফিসের গ্যাঁড়াকলে আটকে হাপিত্যেশ করছেন। নিজের নতুন পাসপোর্ট বানাতে এখানে আসা জাহেদ নামের এক ব্যবসায়ী জানান, তাঁর আবেদন ফরমে সামান্য একটু দাগ পড়েছিল, তাই কাউন্টার থেকে ফেরত পাঠায় তাঁকে। পরে এক দালাল ধরলে সেই আবেদন ফরমে একটা চিহ্ন দেয়। এই চিহ্ন দেখে ঠিক একই কাউন্টার পুনরায় আবেদনটি নিয়ে নেয়।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ও আঞ্চলিক অফিস দুটোতেই কম-বেশি ভোগান্তির অনেক অভিযোগ পাসপোর্ট গ্রহীতাদের। নগরীর মনসুরাবাদে বিভাগীয় ও পাঁচলাইশে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অবস্থান। এই দুই অফিসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি দালালচক্র। অভিযোগ রয়েছে দালাল ছাড়া ফরম জমা দিতে গেলে বিভিন্ন ছলছাতুরির মাধ্যমে বাতিল করা হয়। তখন দালালের মাধ্যমে, না হয় ট্যাভেলস এজেন্সির লোক দিয়ে পাসপোর্ট করাতে হয়। এতে সরকার নির্ধারিত ফির বাড়তি গুনতে হয় সেবাগ্রহীতাকে।

জানা গেছে, সাধারণ পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সরকারি ফি হচ্ছে তিন হাজার ৪৫০ টাকা। দালালরা নিয়ে থাকে পাঁচ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নেওয়া হয় অতিরিক্ত ১১০০ টাকা। জরুরি পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সরকারি ফি ছয় হাজার ৯০০ টাকা। দালালরা ১০ হাজার বা তার বেশি টাকা আদায় করছে।

পাসপোর্ট আবেদনকারীরা বলেছেন, এখানে সবচেয়ে হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশ প্রতিবেদনের (পিভিআর) জন্য। এ হয়রানির কারণে পাসপোর্ট পেতে বিলম্বও ঘটে।

এ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া বলেন, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা একই হলে প্রতিবেদন দিতে সহজ হয়। দুটি ঠিকানা ব্যবহার করা হলে পুলিশ প্রতিবেদন পেতে সময় লাগে।

পাসপোর্টের পিভিআর দেওয়ার জন্য পুলিশের টাকা দাবি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার জসিম উদ্দিন বলেন, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে সেই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের এএসআই পদমর্যাদার একজন পুলিশ সদস্য বলেন, পাসপোর্টের পিভিআর তৈরির কাজের জন্য সরকারের পাসপোর্ট দপ্তর থেকে কোনো ধরনের ভাতার ব্যবস্থা নেই। পাসপোর্টগ্রহীতার ঠিকানায় যাওয়া-আসার খরচ পুলিশ সদস্যকে বহন করতে হয়। একজন পুলিশ সদস্যকে তাঁর প্রাত্যহিক কাজের সঙ্গে এ কাজটিও করতে হয়। তাই অনেক সময় ঠিক সময়ে পুলিশ রিপোর্ট দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।

চট্টগ্রাম নগরের মনসুরাবাদে বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক জাকির হোসেন বলেন, ‘একসময় এ ধরনের কিছু সমস্যা ছিল। এখন আমাদের চেষ্টা কত সহজে গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা যায়।’ পাসপোর্ট অফিসের দালাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অফিসের ভেতরে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। তবে এটা বাইরে হতে পারে।

পাঁচলাইশের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘গত অক্টোবরে যোগদান করলাম। এরই মধ্যে অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। দালাল ও হয়রানিমুক্ত করার লক্ষ্যে পুরো ভবনটিতে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এখানে সেবাগ্রহীতাদের কিভাবে আরো বেশি করে সেবা দেওয়া যায় তা মাথায় নিয়েই কাজ করছি।’

রাজশাহী পাসপোর্ট অফিস : রাজশাহী অফিসের প্রধান জানান, রাজশাহী পাসপোর্ট অফিসে ফরম জমা দিতে আসা শত শত আবেদনকারীকে নানা অজুহাতে প্রতিদিন ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে আবার দালালদের অথবা পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মচারী বা আনসার সদস্যদের পাসপোর্টপ্রতি এক হাজার ৫০০ টাকা দিলে ঠিকই জমা নেওয়া হচ্ছে আবেদন।

সঠিক পন্থায় আবেদনকারীরাই বেশি ভোগান্তিতে পড়ে। ভুক্তভোগীরা জানায়, সরকারি ফি তিন হাজার ৪৫০ টাকার বদলে ছয় হাজার টাকা খরচ করলেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট হাজির হয়ে যায়।

তবে পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক আফজালুর রহমান বলেন, ‘বাইরে কাউকে ঘুষ দিলে আমার কিছু করার নেই। এখানে আমরা শতভাগ সততা নিয়ে কাজ করি। কারো কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলে তার আবেদন জমা না নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।’

এদিকে পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামেও আদায় করা হয় ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। রাজশাহী নগরীর সপুরা এলাকার হযরত আলী নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘পুলিশ তদন্ত করতে এসে আমার কাছে প্রথমে তিন হাজার টাকা দাবি করে। শেষ পর্যন্ত দেড় হাজার টাকা নিয়ে চলে গেছে।’

সিলেট পাসপোর্ট অফিস : সিলেট অফিস জানান, সেখানকার অফিসে পাসপোর্টের আবেদন নিজে জমা দিতে গেলে নানা ঝামেলা। সেই কাগজপত্রে ‘ভুল’ থাকবেই এবং সেটা দেখিয়ে আবেদনকারীকে ফিরিয়ে দেবেনই গোমড়ামুখের কর্মকর্তা। তবে সেই আবেদনে যদি বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন থাকে তবে দ্রুত আবেদন জমা হয়, ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি তোলা হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। তবে সেই বিশেষ চিহ্ন যুক্ত করতে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। এ ছাড়া দীর্ঘ লাইন থাকলেও টাকা থাকলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা আছে। সব মিলিয়ে টাকা হলে সবই হয় সিলেট পাসপোর্ট অফিসে।

সিলেট নগরের দক্ষিণ সুরমার আলমপুরে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। গত বুধবার পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় সরাসরি পাসপোর্টের আবেদন জমা দিতে এসে ব্যর্থ হয়েছেন এমন একাধিক আবেদনকারীর সঙ্গে। তাদের কাউকে কাগজ সত্যায়িত করে আনতে, কাউকে মোহাম্মদ বানান সংক্ষেপে কেন, কাউকে অযথা বাড়তি কাগজপত্র লাগবে বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

নগরের শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী মো. সরোয়ার হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার কাগজপত্রের সব কিছু ঠিক আছে। সত্যায়িত করা কাগজপত্রের একটিতে সিল একটু হালকা হওয়ায় তারা কাগজ রাখেননি। বলেছেন আবার সিল দিয়ে নিয়ে আসার জন্য।’

আরেকজন নাম না বলার শর্তে বললেন, ‘আমার কাগজপত্র সবই ঠিক আছে। সিরিয়াল ঠিক নাই অভিযোগে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন জমা দেওয়া জিয়া উদ্দিন বললেন, ‘তিন দিন আগে যে কাগজপত্রে ভুল আছে বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কর্মকর্তারা আজকে সেই কাগজপত্রই তাঁরা রেখেছেন। ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।’ এ জন্য ট্রাভেলস এজেন্সিকে অবশ্য দুই হাজার টাকা দিতে হয়েছে বলে জানান জিয়া।

জানা গেছে, সিলেট পাসপোর্ট অফিসে পিয়নের দায়িত্ব পালন করা জয়নাল এবং আনসার সদস্য আনোয়ার দালালচক্রের অন্যতম সদস্য। আর বাইরে এই চ্যানেলের সঙ্গে সক্রিয় আছে কুদ্দুস ও মুন্সি নামের দুজন। তারা মূলত বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সির কাছে জমা হওয়া আবেদনপত্র সংগ্রহ করে নিজেদের কাছে নিয়ে আসে। তারপর সেগুলো গোছগাছ করে পাসপোর্ট অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এসব আবেদনপত্রে তখন ছোট্ট করে বিভিন্ন ধরনের ‘চিহ্ন’ আঁকা থাকে। এই চিহ্ন থাকলে আবেদন জমা হয়ে যায়। রাতে সেই চিহ্ন দেখে জয়নালরা ফাইলের সংখ্যা শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট ট্রাভেলস এজেন্সিগুলোর কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাসহ দালালদের মাঝে সেই টাকা ভাগ করা হয়।

এসব বিষয়ে কথা বলতে বুধবার বেলা আড়াইটার দিকে বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক এ কে এম মাজহারুল ইসলামের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

খুলনা পাসপোর্ট অফিস : খুলনা অফিসের প্রধান জানান, খুলনার বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে আবেদন ফরমে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতির অজুহাতে পাসপোর্ট গ্রহীতাকে ঘোরানো হয়। অফিসের বাইরে থাকা দালালদের মাধ্যমে আবার সেই আবেদন গ্রহণ করেন কর্মকর্তারা।

কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী গ্রামের ভুক্তভোগী হরষিত গাইন জানান, ডিজিটাল পাসপোর্টের জন্য আবেদন জমা দিতে এলে দায়িত্বপালনকারী কর্মী তাঁকে তিন দিন ঘুরিয়েছেন। পরে তিনি অফিসের বাইরে এক দালালকে দিয়ে তাঁর কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়েছেন। তবেই জমা দিতে পেরেছেন। ওই দালালকে এক হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সেই সঙ্গে খুলনায় তিন দিন থাকতে তাঁর অনেক খরচ হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ২১ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের পাসপোর্ট সেবায় ৫৫.২ শতাংশ দুর্নীতি হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং দালালদের দৌরাত্ম্যে। পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৭৬ শতাংশ এবং দালালের মাধ্যমে ৪১ শতাংশ মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়। তাদের সবাইকে গড়ে অন্তত দুই হাজার ২২১ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কালের কণ্ঠ

পাঠকের মতামত: