ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের কোটি টাকা বাণিজ্য

ওমর ফারুক হিরু :  কক্সবাজারে সিএনজি অটোরিক্সার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ হাজার। এসব সিএনজির মধ্যে আড়াই হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত। বাকীগুলো লাইসেন্সের পক্রিয়াদিন। আর এই নাম্বার বিহীন সিএনজিগুলো রাস্তায় চলছে পুলিশ টুকেন নামে প্রতিমাসে চাঁদা দিয়ে। প্রায় ৩ হাজারেরও বেশি সিএনজি চলছে ট্রাফিক পুলিশকে চাঁদা দিয়ে। এক একটি সিএনজি থেকে তারা প্রতি মাসে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিচ্ছে। আর চাঁদা বাবদ প্রতি মাসে ট্রাফিক পুলিশের হাতে যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি টাকা। আর ট্রাফিকদের এই কাজে সহযোগিতা করছে প্রত্যেক সিএনজি স্টেশনে থাকা লাইন ম্যান নামধারী কিছু লোক। যারা নাম্বাবিহীন সিএনজি থেকে টাকা উঠিয়ে ট্রাফিকের হাতে তুলে দেয়।
অন্যদিকে অটোরিক্সা সিএনজির নাম্বারের আবেদনের জন্য ব্যাংকে জমা দেয়া সরকারী ফি হচ্ছে ১২ হাজার ১ শত টাকা। কিন্তু বিআরটি কিছু লোক ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়া সহ নাম্বার পত্রের পুরো কাজটি সম্পন্ন করার জন্য নিচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সরকারী ফি ১২ হাজার ১ শত টাকার বাহিরে আর কোন টাকার প্রয়োজন হয়না। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটা লাইসেন্স বাবদ সরকারী খরচের বাহিরে বিআরটিএ হাতিয়ে নিচ্ছে ১৭ হাজার ৯ শত টাকা। যা ৩ হাজার লাইসেন্সে বাড়িতি টাকা হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ৫৩ লাখ ৭০ হাজার।
টাফিক পুলিশ এবং বিআরটিএর বিরুদ্ধে এমনটাই অভিযোগ এনেছেন ভূক্তভোগী অটোরিক্সা সিএনজি চালকেরা। তারা বলছেন যারা তাদের নিরাপত্তা দেবে আর আর লাইসেন্স দেবে তাদের অত্যাচারেই তারা অতিষ্ট।
কিন্তু ট্রাফিক আর বিআরটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, অভিযোগগুলো সঠিক নয়। যথাযথ নিয়মেই মাধ্যমে’ই কাজ চলছে।
ভূক্তভোগী সিএনজি চালকদের দেওয়া অভিযোগে জানা যায়, কক্সবাজার সদর সহ প্রত্যেকটা উপজেলার সিএনজি স্টেশনে একজন বা তারো অধিক লাইন ম্যান রয়েছে। এই লাইম্যানরাই পুলিশ টুকেনের নামে ট্রাফিক পুলিশকে টাকা দেয়। এই পুলিশ টুকেনের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রত্যেকটি সিএনজি থেকে নেওয়া হয় প্রায় ৩ হাজার টাকা। তারা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে সব সিএনজি শুধুমাত্র কক্সবাজারের সদরে চালাবে এসব সিএনজিকে দিতে হবে ২২ শত টাকা। আর প্রত্যেক উপজেলায় দিতে হয় সাড়ে ৩ শত টাকা। আবার একই সিএনজি যদি সদর এবং উপজেলায় চালানো হয় তাহলে তাকে পুলিশ টুকের বাবদ দিতে হবে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এভাবে ৩ হাজার সিএনজি থেকে টুকেন বাবদ প্রতি মাসে ট্রাফিক পুলিশ আদায় করছে প্রায় এক কোটি টাকা। আর ট্রাফিক পুলিশদের টাকা তুলে দেওয়ার দায়িত্বে থাকা লাইন ম্যানগুলোর মধ্যে কক্সবাজার শহরের ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্পে দায়িত্বে রয়েছেন দিদার আর বেলাল। উখিয়া সিএনজি স্টেশনের দায়িত্বে রয়েছে বদি আলম, কোট বাজার কালা পুতু আর সৈয়দ ও রামুতে আলী হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তারাই ট্রাফিকের হাতে টাকা উঠিয়ে দেয়।
কক্সবাজার শহরের সিএনজি স্টেশনে দায়িত্বে থাকা লাইন ম্যানরা স্বীকার করেছেন কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) মহিবুল্লাহর হাতেই তারা প্রতিমাসের পুলিশ টুকেনের টাকা তুলে দেন।
সিএনজির ভূক্তভোগী চালক চালক সাইফুল, ফারুক আর সাজ্জাদ আরো জানান, পুলিশ টুকেন নামে চাঁদা দেওয়ার পরেও অনেক সময় বাড়তি টাকার জন্য হয়রানি করে ট্রাফিক পুলিশ। আর তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করে।
অন্যদিকে বিআরটিএ নাম্বার পত্র দেওয়ার জন্য গাড়ি প্রতি যে ৩০ হাজার টাকা আদায় করে তার মূল টাকা হল ১২ হাজার ১ শত টাকা। বাকী ১৭ হাজার ৯ শত টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বিআরটিএ। একদিকে ট্রাফিক পুলিশ অন্যদিকে বিআরটিএ। এই দুই দপ্তরের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে সাধারণ সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা।
ভূক্তভোগী সিএনজি চালক লিয়াকত মিয়া জানান, নতুন সিএনজি কিনে নাম্বারপত্রের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করতে হলে হয় গাড়ি বিক্রির সু-রুমের লোকজনের সাথে কনট্রাক করতে হয়। নয়ত বিআরটিএর লোকজনের সাথে। উভয় পক্ষই ৩০ হাজার টাকা করে রাখে। গাড়ির সু-রুমের লোকজনের সাথে চুক্তি থাকে বিআরটিএর লোকজনের মধ্যে। আর নাম্বার পত্র পাওয়ার জন্য কাগজ পত্র রেডি করে দেয় জিয়া নামে কোর্ট বিল্ডিং এলাকার এক কম্পিউটার অপারেটর। তার সাথেও সংযোগ রয়েছে বিআরটিএর লোকজনের। তিনি কাগজ পত্র রেডি করে দিতে ১৫ শত টাকা পর্যন্ত রাখেন।
এ ব্যাপারে কোর্ট বিল্ডিং এর আদালত প্রাঙ্গনের কম্পিউটার অপারেটর জিয়া বিষয়টি স্বীকার করে জানান, তিনি বিআরটিএ থেকে নাম্বার পাওয়ার জন্য কাগজ রেডি করে দেন। গাড়ির ধরনের উপর ভিত্তি করেই টাকা নেওয়া হয়।
বিআরটিএর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ব্যাপারে মোটরযান পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম জানান, বিআরটিএ’র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ হাজার ৫ শত ৪৮ টি অটোরিক্সা লাইসেন্সে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আড়াই হাজার লাইসেন্সদারী সিএনজি রাস্তায় রয়েছে। বাকীগুলো অকেজু হয়ে রয়েছে। আর লাইসেন্স পক্রিয়াদিন অবস্থায় রয়েছে ৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত লাইসেন্স পক্রিয়া বন্ধ ছিল। বিআরটিএর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, তাদের ওখানে কোন ফাইল পক্রিয়ার কাজ করা হয়না। আর টাকাও নেওয়া হয়না। পুলিশ টুকেনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তিনি শুনেছেন। এটি খুবই অন্যায়। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ ব্যাপারে বিআরটিএ কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জামাল উদ্দিন জানান, সিএনজির নাম্বার পত্র দেওয়ার জন্য তারা আগ বাড়িয়ে কিছুই করে না। ওখানে কোন ধরনের টাকা পয়সার লেন-দেন হয়না। পুলিশ টুকের বিষয়েও তিনি কিছুই জানেননা। এছাড়া নিদৃষ্ট নিয়ম অনুযায়ী গাড়ির লাইসেন্স করা হয়। এতে কোন ধরনের লেন-দেন হয়না।
এ ব্যাপারে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মহিবুল্লাহ পুলিশ টুকেনের নামে টাকা তোলার বিষয়টি অস্বিকার করে বলেন, এই ধরনের কিছুই ট্রাফিক পুলিশ করেনা। এছাড়া তিনি এ বিষয়ে জানেন না। একইভাবে কক্সবাজারের সিনিয়র ট্রাফিক ইন্সপেক্টর বিনয় কুমার বড়–য়া জানান, ট্রাফিক পুলিশ এই ধরনের কোন টুকেন দেননা।

পাঠকের মতামত: