ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ৬০ হাজার টাকায়! রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় সংঘবদ্ধ চক্র

অনলাইন ডেস্ক ::

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই নানা কৌশলে ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ হয়ে যাচ্ছেন। টাকা দিলেই মিলছে জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, চেয়ারম্যান সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। পরিচয় লুকিয়ে তারা অন্যের কাগজপত্রও ব্যবহার করছেন। টাকার বিনিময়ে সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্র এসব কাগজ তৈরিতে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছে। ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করলেই মিলছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আর এসব কাগজপত্র ব্যবহার করেই তারা ভোটার হচ্ছেন। অনেকেই আবার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বিদেশে গিয়ে রোহিঙ্গাদের অনেকে নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়ছে। রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট তৈরি করে বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে যেতে না পারে, সেজন্য কঠোর নজরদারি চলছে। এর পরও দালাল চক্রের সহায়তায় তারা নানা কৌশলে পাসপোর্ট পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনেরও (ইসি) উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার তালিকায়

অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে সেজন্য হালনাগাদ করার সময় বৃহত্তর চট্টগ্রামের চার জেলার অন্তর্ভুক্ত ৩২ উপজেলায় বিশেষ সতর্কতা জারি করে কার্যক্রম চালাতে বাধ্য হয় ইসি। একইভাবে বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে পাসপোর্ট অফিসগুলোকেও। বিভিন্ন স্থানে পাসপোর্ট করতে গিয়ে বেশকিছু রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ধরা পড়ায় পাসপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক অফিসগুলোকে আরও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরও। সূত্র জানায়, দালাল চক্রের সদস্যরা

ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সাহায্য করছে চক্রে।

পাসপোর্ট অফিসের দালাল, ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্মকর্তা, পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় কর্মচারীও রয়েছে। ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন প্রতিবেদনের জন্য পুলিশের এসবি শাখার সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাকে দিতে হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা গড়ে ২০ হাজার টাকা এবং দালালরা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে নিয়ে থাকে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে টাকার অঙ্ক আরও বাড়ে।

জানা যায়, বিভিন্ন সময় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পাসপোর্ট অফিসে ভুয়া পরিচয়ে পাসপোর্ট তৈরি করতে গেলে ধরা পড়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা। দালালরা এখন চট্টগ্রাম অঞ্চলকে এড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বানিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই এভাবে পাসপোর্ট করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি জেলায় রোহিঙ্গা আটকও হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভাষা অনেকটাই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মতো। আচার-ব্যবহারেও এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিল রয়েছে। ফলে তাদের শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।

বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান সমকালকে বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট না পায়, সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। আঞ্চলিক অফিসগুলোকেও বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাসপোর্ট করার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাধ্যতামূলক। তাই পুলিশ রিপোর্ট ইতিবাচক হলে অনেক সময় পাসপোর্ট অফিসগুলোর কিছু করার থাকে না।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গারা যাতে পাসপোর্ট না পায়, সে জন্য গত ২১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পরিদর্শনকালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। বৈঠকে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তাদের বিশেষভাবে সতর্ক করে দেন তিনি।

১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে গিয়ে মরিয়ম বেগম নামে এক রোহিঙ্গা নারী ধরা পড়েন। তিনি নিজেকে নগরীর বাকলিয়া থানাধীন সালে আহমেদ নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী পরিচয় দেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী পরিচয়ের সালে আহমেদও। পরে মরিয়ম বেগম স্বীকার করেন, তার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুতে। সালে আহমেদ তার আসল স্বামী নন। এর কয়েক দিন আগে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে গর্ভবতী সেজে পাসপোর্ট পেতে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে আবেদন করেন ফাতেমা বেগম নামের আরেক রোহিঙ্গা। পাসপোর্ট অফিস জানায়, দুই নারীর পাসপোর্টের আবেদনেই ছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ।

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, অধিদপ্তরের বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী পাসপোট তৈরির ক্ষেত্রে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। গত এক বছরে চট্টগ্রামে দুই শতাধিক সন্দেহভাজনকে আটকে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত অক্টোবরে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলাকালে রোহিঙ্গারা তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কায় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙামাটির ৩২ উপজেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় চট্টগ্রামে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী ও নির্বাচন কমিশনের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন। ২৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপজেলাগুলোয় ভোটার করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মঈন উদ্দিন খান বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে না পারে, সেজন্য ৩২টি উপজেলায় ৩২টি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এসব এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার, পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলর, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। খসড়া ভোটার তালিকায় কোনো রোহিঙ্গা ঢুকে পড়েছে কি-না তা এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। সুত্র: সমকাল

পাঠকের মতামত: