ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

আওয়ামী লীগের চিন্তা জাপা বিএনপির টেনশন জামায়াত, ভোটের হাওয়া : চট্টগ্রাম-১৬

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি ::

চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মনোনয়ন যুদ্ধে নেমেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর অর্ধডজন প্রার্থী। এখানে চারবার এমপি হওয়া জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর আবারও বিএনপি থেকে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্ত কোনো প্রার্থী না থাকায় বিএনপিতে মনোনয়নের লড়াই অনেকটাই নিষ্প্রভ। এর ঠিক বিপরীত চিত্র আওয়ামী লীগে। দল তো আছেই, মহাজোটের প্রার্থিতা নিয়েও গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে দলটির নীতিনির্ধারকদের।

আওয়ামী লীগে আসনটির বর্তমান এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে মাঠে আছেন আরও দুই শক্ত প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও আবদুল্লাহ কবির লিটন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ সমীকরণ আবার পাল্টে দিতে পারে জোট-মহাজোটের হিসাব। কারণ, ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন হলে মহাজোট থেকে এখানে জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী প্রার্থী হতে চাইবেন। ২০ দলীয় জোটের ক্ষেত্রেও একইভাবে বিএনপিকে দরকষাকষি করতে হবে জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা জহিরুল ইসলামের সঙ্গে।

বাঁশখালীতে ২০১৪ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। এ দল থেকে এর আগে সর্বশেষ ১৯৯১ সালে এমপি হন সুলতানুল কবির চৌধুরী। এ ছাড়া ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে এখানে শেষ হাসি হাসেন ধানের শীষের প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী।

আওয়ামী লীগে প্রার্থিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য মনোনয়নপ্রার্থীর কঠিন চ্যালেঞ্জে রয়েছেন ২০১৪ সালে বাঁশখালীতে নির্বাচিত এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অভিযোগও আনছেন দলের সম্ভাব্য অন্য প্রার্থীরা। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত চার বছরে হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে বাঁশখালীতে। এর আগের চারটি নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হলেও এবার চার বছরে যে কাজ হয়েছে, তা ৪০ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে ফের নৌকার ওপরেই আস্থা রাখতে হবে জনগণকে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপর আবারও আস্থা রাখলে বাঁশখালীতে নৌকা বিজয়ী হবে। তবে মনোনয়ন না পেলেও তিনি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। দলের একটি অংশের বিরোধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার নেতৃত্বে আস্থাশীল। নির্বাচন এলে কিছু মৌসুমি প্রার্থী পানি ঘোলা করার চেষ্টা করেন। সুসময়ের এসব কোকিল সম্পর্কে শুধু স্থানীয় নেতাকর্মীই নন, কেন্দ্রও অবহিত।

তবে এমপির এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছে আওয়ামী লীগের আরেক অংশ। তাদের দাবি, পছন্দসই নির্বাচন কর্মকর্তা নিয়োগ না দেওয়ায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে মারধর, চাচাকে চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতানো, নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রকল্পের নামে টিআর-কাবিখার টাকা লুট, সাংবাদিককে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, জামায়াতপ্রীতি, দলকে কুক্ষিগত করা, দলীয় নেতাকর্মীদের মামলায় জড়ানো, অনুসারীদের দিয়ে নামে-বেনামে টিআর-কাবিখার টাকা লুটসহ নানা অভিযোগ রয়েছে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ জন্য এ অংশের অনুসারীরা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থী প্রত্যাশা করছেন। আর সম্ভাব্য নতুন প্রার্থীরাও এলাকায় শোডাউন করছেন। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে এ নিয়ে গত মাসেও গোলাগুলি হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটন বলেন, বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগদলীয় হলেও তার অত্যাচারে নেতাকর্মীরা অতিষ্ঠ। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদেরও গুলি করতে দ্বিধা করেন না। গত মাসে একটি সভা করার উদ্যোগ নিলে নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে ২৩ জনকে আহত করে এমপির অনুসারীরা। আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে প্রার্থী হতে আগ্রহী আবদুল্লাহ কবির লিটন। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আস্থা রাখলে বিজয় পাবেন বলে তার বিশ্বাস।

সম্ভাব্য আরেক প্রার্থী ব্যবসায়ী নেতা ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান বলেছেন, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আস্থা রাখলে নৌকার মাঝি হিসেবে বিজয়ী হবেন তিনিই। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে দান-খয়রাত করে আসছেন। তার দানে এলাকায় একাধিক স্কুুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি তার নিজ প্রতিষ্ঠানে এলাকার অন্তত ২০ হাজার বেকার যুবকের কর্মসংস্থান করেছেন।

তবে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হতে পারে জাতীয় পার্টি। তারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে থাকলে এ আসনে সাবেক এমপি ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মনোনয়ন চাইবেন। এর মধ্যে তিনি হোমওয়ার্কও শুরু করেছেন। এলাকায় বাড়িয়েছেন যোগাযোগ। এ প্রসঙ্গে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জনগণ চাইলে তিনি আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন। এলাকার সঙ্গে তার যোগাযোগও রয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকজন এর আগে তার একটি অনুষ্ঠান পণ্ড করেছে। যদিও সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। এ অনুষ্ঠানটি আবার করার উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। কারণ বাঁশখালীর মানুষের কাছে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী নতুন কেউ নন। তিনি ১৯৭৯, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমন ঠেলাঠেলিতে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বিএনপি। দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি পদে থাকা এবং বাঁশখালী থেকে টানা কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হওয়ায় প্রার্থিতার ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত জাফরুল ইসলাম চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাঁশখালীর মাটি বিএনপির ঘাঁটি। টানা চারবার এমপি নির্বাচন করে ধানের শীষের প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রমাণও দিয়েছে এলাকাবাসী। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। এবার যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়, তবে আবারও এখানে শেষ হাসি হাসবে ধানের শীষের প্রার্থী। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আস্থা রাখলে নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছেন বলে জানান তিনি।

এ আসন থেকে বিএনপির টিকিট চাইবেন এমন আরও দু’জন হচ্ছেন সাবেক পৌর মেয়র ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক কামরুল ইসলাম হোসাইনী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত কামরুল ইসলাম হোসাইনী বলেন, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আস্থা রাখলে তিনি নির্বাচন করতে প্রস্তুত। তবে দল থেকে যাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হবে, তার হয়েই কাজ করবেন বলে জানান তিনি। বিএনপির অপর এক মনোনয়নপ্রত্যাশী চাইছেন গণ্ডামারায় বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচিত হওয়ার ইতিবাচক দিককে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের প্রতীক নিতে।

বাঁশখালীতে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী থাকলেও তাদের অনেকটাই টেনশনে রেখেছে জামায়াতে ইসলামী। এ আসনে প্রার্থী দিতে বিএনপির সঙ্গে দরকষাকষি করবে তারা। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান হাতিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম। উপজেলা চেয়ারম্যানের পাশাপাশি ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও জামায়াতের লোক। এ প্রসঙ্গে উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির জহিরুল ইসলাম বলেন, বাঁশখালীতে জামায়াতে ইসলামীর ভালো জনসমর্থন রয়েছে। এ জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের তিনটি পদেই জামায়াতে ইসলামী সমর্থিতকে বিজয়ী করেছেন ভোটাররা। নির্বাচন জোটবদ্ধ হলে জামায়াতে ইসলামী বাঁশখালী আসন চাইবে। প্রার্থী হিসেবে প্রস্তুতিও আছে তার।

জোটের হয়ে নির্বাচনে দেখা যেতে পারে ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের চেয়ারম্যান মুফতি ইজহারুল ইসলামকেও। তবে মামলায় জড়িয়ে এখন কিছুটা বেকায়দায় আছেন তিনি।

পাঠকের মতামত: