ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজারে বেড়েছে ক্লিনিক, সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন

012-768x318অজিত কুমার দাশ হিমু ::
পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার। এখানে প্রাইভেট ক্লিনিকের সংখ্যা গনিতিক হারে বাড়লেও বাড়ছে না চিকিৎসা সেবার মান। ফলে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন। ভূক্তভোগী চিকিৎসার্থীরা জানালেন, অধিকাংশ ক্লিনিকেই সার্বক্ষণিক ডাক্তার-নার্স, কিংবা আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ব্যবস্থাদি নেই। বছরের পর বছর সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই ক্লিনিকগুলো পরিচালিত হলেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। তবে ক্লিনিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন সিভিল সার্জন।
এক দিকে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অপরদিকে বাড়ছে না ক্লিনিকগুলোর চিকিৎসা সেবার মান। স্বাস্থ্য বিধি মোতাবেক প্রতিটি ক্লিনিকে সার্বক্ষণিক ডাক্তার-নার্স থাকার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্লিনিকে তা নেই। দু’একটি বাদে কোন ক্লিনিকেই মানসম্মত অপারেশন থিয়েটারসহ আনুষঙ্গিক জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়াই করা হচ্ছে অস্ত্রোপচার। ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে রোগীদের চিকিৎসা সেবা।
কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামপুর এলাকা থেকে আসা ষাটোর্ধ আফলাতুন বলেন, সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে তাকে রেফার করা হয়েছিল একটি বেসরকারী হাসপাতালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৫/৬ দিন চিকিৎসার কেবিনে রেখে অর্ধলাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। চট্টগ্রামে চিকিৎসা নিয়েই তিনি এখন সুস্থ। কিন্তু মাঝ পথে অর্থ ও সময় নষ্ট করে তার জীবন বিপন্ন করে তুলেছিল ওই প্রাইভেট হাসপাতালটি। তার মতো ওই সব ভুইফোঁড় হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে অনেক রোগীর জীবন এখন বিপন্ন হয়েছে। হারিয়ে সহায় সম্বল। অপচিকিৎসায় মারাও গেছেন অনেকে ।
তিনি আরও জানান ‘এখানে চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের নেই কোনও হস্তক্ষেপ, নেই কোন তদরকি।’ ফলে বিপাকে পড়েছে চিকিৎসার্থীরা।
ভুক্তভোগী শাহজাহান মিয়া নামের এক ব্যক্তি জানান, আমার প্রসূতি স্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য শহরের সরকারী পারিবারিক স্বাস্থ্য (মেটারনিটি) কেন্দ্রে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা যথাসময়ে সিজার না করায়, অবহেলার কারণে আমার শিশুটি প্রতিবন্ধি হয়েছে।
তিনি জানান, আমি শিশুটির চিকিৎসার জন্য রাজধানী ঢাকায় একটি হাসপাাতলের স্মরনাপন্ন হলে ওই ডাক্তার আগের চিকিৎসাকে ভূল বলে অবহিত করেন।
কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়ার মমতাজ আকতার নামের শিক্ষিতা এক গৃহবধু জানান, আমি গত কিছুদিন আগে প্রসব বেদনায় শহরের প্রাইভেট একটি ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছিলাম। অপারেশনের কিছুদিন পর আমার আবার ব্যাথা উঠে। ব্যাথার জন্য আলট্রাসনোগ্রাম করতে গেলে ধরা পরে আমার পেটে সুতা জাতীয় কিছু আছে। পরে ঐ ডাক্তারের কাছে গেলে আমাকে আবার অপারেশন করেন। অপারেশনের পর পেট থেকে পূর্বের অপারেশনের সময় ভেতরে আটকে থাকা একটি লম্বা সুতা বের করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সব হাসপাতাল, ক্লিনিক গুলোতে মৃত ব্যক্তিদের বাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় তা প্রকাশ না পাওয়া, সচেতনতার অভাবে অভিযোগ না করা ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে মৃত্যুর ঘটনা ধাপাচাপা দেয়াসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত রয়ে যাচ্ছে।
এইসব অস্বাভাবিক মৃত ব্যক্তির স্বজনেরা অভিযোগ তুলেছেন, কক্সবাজারের প্রতিটি বেসরকারী হাসপাতাল-ক্লিনিকে চলছে চিকিৎসা সেবার নামে রমরমা প্রতারণা ব্যবসা। শুধু প্রাইভেট হাসপাতাল নয় একই অবস্থা চলছে জেলা সদর সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলোতে। তারা চিকিৎসা সেবার নামে শুধু ব্যবসা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, মৃত কিংবা অপমৃত্যুর কবলে পড়া ব্যক্তির লাশ নিয়েও করেছেন নানা টালবাহানা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কতিপয় চিকিৎসক, দালাল- কর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা মিলে প্রতিটি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোকে গড়ে তুলেছে “মানুষ মারার কারখানা।” এরপরও উপায় না পেয়ে সাধারণ মানুষ এইসব মানুষ মারার কারখানা গুলোতে যাচ্ছেন চিকিৎসা নিতে। রীতিমতো জীম্মিদশায় আছেন কক্সবাজার জেলার লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। তথাকথিত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো তাদের প্রচারণায় তাদের প্রতিষ্ঠানকে অত্যাধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বললেও সরেজমিনে এর ছিঁটেফোটাও নেই।
তবে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকারি নিয়মনীতি মেনেই তারা ক্লিনিক পরিচালনা করছেন।
জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক জাহাঙ্গীর কাসেম বলেন, ‘আমাদের এখানে সার্বক্ষণিক চিকিৎসক রয়েছে। এ ছাড়াও যদি কোনও রোগীর চিকিৎসা দেয়া আমরা সক্ষম নই বলে মনে করি তাকে আমরা নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সে করে কক্সবাজারের বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করে থাকি।’
এদিকে কক্সবাজার শহরে অবস্থিত কয়েকটি ক্লিনিকে প্রতি শুক্রবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা আসেন। যারা আসেন তাদের শতকরা ৩০ ভাগই ভুয়া বলে জানা যায়। ঐসব ভুয়া ডাক্তারদের ঔষধ খেয়ে রোগীরা রোগমুক্তি না হয়ে আবার নতুন কোনো রোগ নিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছেন ঐসব ক্লিনিকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রাইভেট ক্লিনিকের ব্যবস্থাপক জানান, এখন আর পল্লী চিকিৎসকদের ঔষধ বিক্রি করতে হয় না। তারা এখন প্রাইভেট ক্লিনিকের দালাল হয়ে কাজ করেন। গ্রামাঞ্চলের কোনো লোকের পেট ব্যথা হলেই তাদের বুঝানো হয় এপেন্ডিসাইট হয়েছে, অপরেশন করতে হবে। সাথে সাথে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রাইভেট হাসপাতালে।
তারপর রোগীদেরকে অপারেশন থিয়েটারে দিয়ে পারসেন্টিজ নিয়ে চলে যান। এরকম মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে অনেক দালাল এখন প্রতিষ্ঠিত।
অবশ্য ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালেন কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন।
তিনি বলেন, ‘সার্বক্ষণিক ডাক্তার না থাকার বিষয়টির যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে আমরা অবশ্যই সেই সব ক্লিনিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, কক্সবাজার জেলায় অর্ধশতাধিক ক্লিনিক। এর মধ্যে লাইসেন্সবিহীন ২০টির অধিক। গত কয়েক বছরে এসব ক্লিনিকে ডাক্তার-নার্সদের অদক্ষতায় মারা গেছেন অনেক রোগী।

পাঠকের মতামত: