ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

লামায় পাহাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ইটভাটা গুলো বহাল তবিয়তে

নিজস্ব প্রতিবেদক ::

লামা উপজেলার নবগঠিত ফাইতং ইউনিয়নে সরকারি কোনো অনুমোদন ছাড়াই পাহাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ২৪টি অবৈধ ইটভাটা বহাল তবিয়তে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

ফাইতং এখন একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন। কিন্তু বছর তিনেক আগে এটি ছিল আজিজনগর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড। চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। জনসংখ্যা ১৬ হাজারের বেশি নয়। কিছুটা নির্জন হওয়ায় এখানে পাহাড় কাটতে সুবিধা! তাই এত ইটভাটা এখানে। ২০১৬ সালে শিবাতলী পাড়া ও মংবাচিং পাড়ায় যেসব পাহাড়কে অবশিষ্ট দেখা যায়, গত সপ্তাহে গিয়ে দেখা গেল, সেই পাহাড়ও হয়ে গেছে সমতল। ইটভাটাগুলোতে পাহাড়ের মাটি কেটে তৈরি করা মণ্ড নির্ধারিত ডাইসে ফেলে তৈরি হচ্ছে ইট। বাজারজাত করার উপযোগী করতে ভাটায় পুড়ছে বনের কাঠ। বড় বড় ট্রাক বোঝাই হয়ে লাখ লাখ ইট যাচ্ছে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ আশপাশের এলাকায়। ভারী ট্রাকের ভারে কোটি কোটি টাকার সড়ক ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে।

শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে তিনটি ইটভাটা। দুটি ভাটার মালিক বেলাল হোসেন। অন্যটি মোহাম্মদ হুমায়ুনের। স্কুলের মাঠ চলে গেছে তাঁদের দখলে। ভেতরে বসে ধোঁয়ার চোখ পোড়ানোর সঙ্গে যুদ্ধ করছে কোমলমতি শিশুরা।

ফাইতং ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন জানান, ২০১৫ সালে ফাইতং ইউনিয়নের ইটভাটাগুলোকে ব্যবসায়িক সনদ (ট্রেড লাইসেন্স) দেওয়া হলেও পরিবেশ বিনষ্টের আশঙ্কা এড়াতে এর পরের বছর তিনি কোনো ইটভাটার অনুকূলে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করেননি। ২০১৭ সালেও লাইসেন্স পেতে ভাটা মালিকদের প্রচণ্ড চাপ ছিল। কিন্তু অনড় ছিল ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদ।

এ অবস্থায় তাঁকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রকাশ্যে ভাটায় ইট পুড়ছে। ধ্বংস হচ্ছে বন, মাটি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ।

গত বছর বিভিন্ন পত্রিকায় এ নিয়ে বেশ কটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি। গত সপ্তাহের অনুসন্ধানে জানা গেল, ইটভাটার সামগ্রিক পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না হলেও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ আরো গাঢ় করতে এ বছর বদলে গেছে ফাইতং ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতির পদ। ২০১৬ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আজিজনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন। তাঁর স্থলে এবার সভাপতি হয়েছেন মোহাম্মদ কবির। তিনি আরো বেপরোয়া। অপরিচিত কারো টেলিফোন তিনি ধরেন না। কোনো কারণে রিসিভ করলেও সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া মাত্রই লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার একজন মালিক বলেন, ‘পরিস্থিতি সামাল দিতে এ বছর ভাটাপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে চাঁদা তুলে কবির বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করছেন। তাই এবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমরা ইট পোড়াচ্ছি। ’

বেপরোয়া বৃক্ষকর্তন, পাহাড় থেকে মাটি লুট এবং পানির উৎসগুলো শুকিয়ে গিয়ে ফাইতং এলাকায় পরিবেশ এতটা বিপন্ন হয়ে পড়েছে, ২০১৫ সালে পাহাড়ধসে ১৩ জনের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তাতেও টনক নড়েনি কারো। ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করতে ইউনিয়ন পরিষদ যতটা দায়িত্বশীল হয়েছে, এর একাংশও ভূমিকা নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন। মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে লামা উপজেলা পরিষদ। কয়েক গজের মধ্যেই পুলিশ ফাঁড়ি এবং বন বিভাগের বিট অফিসারের কার্যালয়। কিন্তু বন ও পাহাড় ধংসের এমন হরিলুটের মাঝখানে বসে তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করছেন। অন্য কয়েকটি এলাকায় ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। শুধু ‘অক্ষত’ রয়ে গেছে ফাইতং।

২০১৬ সাল থেকে ফাইতংয়ের ইটভাটা মালিকরা কৌশলী হয়েছেন। ট্রেড লাইসেন্স, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং ইটভাটার জন্য জেলা প্রশাসনের কোনো লাইসেন্স না নিলেও সরকারকে খুশি রাখতে ওই বছর থেকে তাঁরা বিপুল অংকের ভ্যাট পরিশোধ করা শুরু করেন। ২০১৭ সালেও ভাটাপ্রতি ৩ লাখ ৯৮ হাজার টাকা করে ভ্যাট জমা হয়েছে ভ্যাট বিভাগে।

বান্দরবান ভ্যাট অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই বিভাগে দুটি সার্কেলে রয়েছে। সব মিলিয়ে এবার তাঁরা ৪৬টি ইটভাটার কাছ থেকে মোট ১ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার টাকার ভ্যাট আদায় করেছে।

ট্রেড লাইসেন্স বা অনুমোদনবিহীন ইটভাটা মালিকরা কীভাবে ভ্যাট নিবন্ধন করেছেন জানতে চাইলে একজন সুপারভাইজার বলেন, ‘কেউ নিজ থেকে নিবন্ধন না করলে ফোর্সলি নিবন্ধন করার বিধান আছে। এই বিধান অনুযায়ী সরকারের রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করতে ফাইতং ইউনিয়নের ২৪ ইটভাটাসহ জেলার মোট ৪৬টি ভাটার নিবন্ধন করা হয়েছে এবং তাঁদের কাছ থেকে নিয়মিত ভ্যাট নেওয়া হচ্ছে। ’

দিনের পর দিন বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি এলাকা ফাইতং। উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো সমতল হচ্ছে। বৃক্ষগুলো উজাড় হতে হতে মরুময় হয়ে গেছে পুরো এলাকা। ভরাট হয়ে গেছে ছোট ছোট পাহাড়ি ছড়া ও খাল। কোথাও ফসলি জমি নেই। ফলের বাগান নেই। নেই বৃক্ষবাগান। ডেস্টিনি লিমিটেড যেসব এলাকায় বনবাগান সৃজন করেছিল, তাও উজাড়। কিন্তু এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। পরিবেশ ক্রমশঃ বসবাসের প্রতিকূল হয়ে পড়ায় অনেকে ছাড়তে শুরু করেছেন বাপ-দাদার ভিটে মাটি। তাহলে কি এক সময় এই জনপদ বিরানভূমিতে রূপ নেবে?

পাঠকের মতামত: