ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের হাওয়া চট্টগ্রাম-১৫, ত্রিমুখী লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীও এ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই তিন দলের ১৩ প্রার্থী আছেন নির্বাচনী মাঠে। তবে শেষ পর্যন্ত ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে অংশ নিলে কপাল পুড়বে বিএনপির সম্ভাব্য চার প্রার্থীর। এ নিয়ে টানাপড়েন চলছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির।

আওয়ামী লীগে এমন অবস্থা না থাকলেও এ আসনে তাদের মাথাব্যথার একমাত্র কারণ দলের দ্বিধাবিভক্তি। আগামী নির্বাচনে বর্তমান এমপি অধ্যাপক ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ায় বেশ আগেভাগেই আটঘাট বেঁধে নেমেছেন আওয়ামী লীগেরই অর্ধডজন সম্ভাব্য প্রার্থী।

জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে আবারও বিজয় পতাকা ওড়াতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন অধ্যাপক ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী। তবে তাকে এবার চ্যালেঞ্জ জানাবেন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, দলের কেন্দ্রীয় উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, সাতকানিয়া উপজেলা সভাপতি এম এ মোতালেব, অ্যাডভোকেট আ ক ম সিরাজুল ইসলাম ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান।

অন্যদিকে ধানের শীষ প্রতীক পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে রয়েছেন দলের দক্ষিণ জেলা সহ-সভাপতি অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন, দক্ষিণ জেলা প্রচার সম্পাদক নাজমুল আমিন মোস্তফা, সাতকানিয়া উপজেলা সভাপতি মুজিবুর রহমান, সাতকানিয়া উপজেলা সাবেক সভাপতি এম এ গাফ্‌ফার চৌধুরী ও লোহাগাড়া উপজেলা সাবেক সভাপতি আসহাব উদ্দিন চৌধুরী। জামায়াতে ইসলামীর হয়ে এখানে মনোনয়ন যুদ্ধে আছেন সাবেক দুই এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম ও শাহাজাহান চৌধুরী।

সাতকানিয়া উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা এবং লোহাগাড়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে চট্টগ্রাম-১৫ আসন। প্রথম আটটি সংসদ নির্বাচনের কোনোটিতেই এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জিততে পারেননি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অধ্যাপক ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন নদভী হেসেখেলে বিজয়ী হন এখানে।

আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাওয়া প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী জানান, দীর্ঘ সময় এই আসন জামায়াতে ইসলামীর ঘাঁটি ছিল। তিনিই প্রথম আওয়ামী লীগের বিজয় পতাকা ওড়ান এ আসনে। তার সময়ে শতকোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, নতুন ভবন স্থাপনসহ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কাজের ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামী নির্বাচনেও জনগণ নৌকার ওপরই আস্থা রাখবে বলে আশাবাদী তিনি। আর মতানৈক্য কাটিয়ে দলকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় তার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও তার ওপর আস্থা রাখবেন।

তবে এমপির বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন আওয়ামী লীগের অন্য সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাতকনিয়া উপজেলা ও লোহাগাড়া উপজেলা কমিটির সঙ্গে এমপির বিরোধ রয়েছে। এ কারণে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষও হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আগমন উপলক্ষে সাতকানিয়ার কেরানীহাটে আয়োজিত জনসভাকে ঘিরে মারামারিতে লিপ্ত হয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপ।

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আর ১৯৯৬ সালে এ আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়েই স্থানীয় সংগঠনে নতুন করে গতি আসে। তিনি আরও বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে প্রতিটি নির্বাচনেই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে তিনি সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন। গত নির্বাচনে একমাত্র তিনিই সার্বক্ষণিকভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে ছিলেন। এতে একেবারেই নিরাপদ অবস্থানে থেকে দলীয় প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী জানান, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গেও তার সখ্য রয়েছে। তিনি এখন আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবারও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন।

ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আমিনুল ইসলাম আমিন বলেন, এমপির জামায়াতপ্রীতির কারণে সাতকানিয়াতে দলের সাংগঠনিক অবস্থা ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। টিআর, কাবিখাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও হয়নি যথাযথভাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন পরিবর্তন। আগামী নির্বাচনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা পরিবর্তনের পক্ষেই অবস্থান নেবেন বলে বিশ্বাস তার। তেমন হলে তিনিও এ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন।

দলের সাতকানিয়া উপজেলা সভাপতি ও চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক এম এ মোতালেব মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে তার ওপরই আস্থা রাখবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। কারণ দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তিনি। নেতাকর্মীরা তাকে সুখে-দুঃখে পাশে পেয়েছে। ব্যবসায়ী নেতা হওয়ায় তিনি এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজও করতে পেরেছেন।

অ্যাডভোকেট আ ক ম সিরাজুল ইসলাম জানান, দলীয় মনোনয়নের যুদ্ধে তিনিও আছেন। তার বিশ্বাস, দলের প্রতি ত্যাগ ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের দিক বিবেচনায় নিলে তিনিও মনোনয়ন পেতে পারেন।

ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে তারই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তার ভাষায়, গত নির্বাচনেও দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার প্রত্যাশা, আগামী নির্বাচনে সেই ত্যাগের মূল্যায়ন করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।

এ আসনে সবচেয়ে বেশিবার নির্বাচিত হলেও বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থা খুবই নাজুক। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার পর এখানে সবচেয়ে বেশি তাণ্ডব হয়। তবে জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্র শিবিরের প্রথম সারির নেতাদের কেউই এখন আর এলাকায় নেই। নেতাকর্মীরা একাধিক মামলার আসামি হওয়ায় সাংগঠনিক অবস্থাও প্রায় ভেঙে পড়েছে। সাবেক দুই এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম ও শাহাজাহান চৌধুরীও এলাকায় নিষ্ফ্ক্রিয়। তবে তারা আগামী নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন চাইবেন।

জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন পেলে কপাল পুড়বে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের। অবশ্য দলীয়ভাবেও খুব একটা শক্ত অবস্থানে নেই বিএনপি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলও তাদের দুর্বল করে রেখেছে। তবুও আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন চাইবেন বিএনপি নেতা অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দীন। তিনি বলেন, তৃণমূলের সঙ্গে তার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। দলীয় চেয়ারপারসন তার ওপর আস্থা রাখলে এখানে বিজয়ী হবে ধানের শীষ।

নাজমুল আমিন মোস্তফা জানান, জামায়াত ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে নির্বাচন করলে এ আসনের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। তবে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করলে তিনি এ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক পেতেও পারেন।

মুজিবুর রহমান বলেন, সাংগঠনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকায় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া দলকে শক্তিশালী করতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এসব বিবেচনায় নিলে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।

এম এ গাফ্‌ফার চৌধুরী জানান, দলের প্রতি ত্যাগ স্বীকারের বিষয়টি হিসাবে নিলে তিনি বিএনপির মনোনয়ন পেতে পারেন। তার বিশ্বাস, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দেবেন।

আসহাব উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিটি কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয় অবদান রাখছেন। এসব কারণে তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

পাঠকের মতামত: