ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

৬ ঘণ্টা অবরুদ্ধ প্রধান শিক্ষক

সাতকানিয়া প্রতিনিধি ::

এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগে এক স্কুলের প্রধান শিক্ষককে ৬ ঘণ্টা তালাবদ্ধ করে রাখলেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকার লোকজন। এরপর পুলিশ এসে ওই শিক্ষককে তালাবদ্ধ অবস্থা থেকে উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সাতকানিয়া উপজেলার চরতি দুরদুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে গতকাল শনিবার বিকেলে ঘটেছে এ ঘটনা। প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করতে তালাও ভাঙ্গতে হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

প্রত্যক্ষদর্শী, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তিন সপ্তাহ আগে একই ঘটনায় স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিকেও অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। ওই সময় সকলের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল এসএসসির ফরম পূরণ বাবত এক শিক্ষার্থী সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে দেবে। কিন্তু গতকাল শনিবার ফরম পূরণের শেষদিনে কারো কারো কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দাবি করার অভিযোগ ওঠে। এরপরও নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি স্কুল কর্তৃপ  তরফে। এতে দুপুরের দিকে উত্তেজনা শুরু হয়। পরে এ নিয়ে প্রধান শিক্ষকসহ আরো কয়েকজন শিক্ষকের সাথে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে প্রধান শিক্ষককে তার কক্ষে তালাবদ্ধ করা হয়। বিকেলে তার কক্ষে লাগানো এ তালা সাতকানিয়া থানা পুলিশ ভেঙ্গে ফেলে। এসময় লোকজন বিক্ষোভ দেখায় এবং প্রধান শিক্ষকের অপসারণ ও স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতিসহ অন্যান্যদের বরখাস্ত দাবি করেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদেরকে ফরম পূরণের সুযোগ না দেয়ায় তারা এমন ঘৃনিত কাজ করেছে।

এ বিষয়ে সাতকানিয়া থানাও ওসি মোহাম্মদ রফিকুল হোসেন বলেন, দুরদুরি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শংকর বসাককে তার কক্ষে লাগানো তালা ভেঙ্গে উদ্ধার করি। অতিরিক্ত ফি নেয়া নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকার লোকজনের সাথে একটা ঝামেলার কথা শুনে পুলিশ পাঠানো হয়।

প্রসঙ্গত, এবার অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে নিয়মিত পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ফরম পূরণে বোর্ড কর্তক নির্ধারিত ফি ১ হাজার ৫৬৫ টাকা। অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ১ হাজার ৮৮৫ টাকা।

ব্যবসায় শিক্ষার্থীদের (নিয়মিত) ক্ষেত্রে এ ফি ১ হাজার ৪৭৫ টাকা। অনিয়মিতদের ক্ষেত্রে ১ হাজার ৭৯৫ টাকা।মানবিক বিভাগে ব্যবসায় শাখার শিক্ষার্থীদের সমহারে এসএসসির ফরম পুরণের ফি নির্ধারিত আছে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের তরফে।

চরতি ইউনিয়নের সাত–আটটি গ্রামের (দক্ষিণ চরতি, দুরদুরী, সুইপুরা, পানি চরতি, ব্রা নডেঙ্গা, দ্বীপ চরতি, তাঁলগাও ) একমাত্র বিদ্যালয় এটি। বিদ্যালয়টিতে প্রায় ৬৫০ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে।

আমাদের সাতকানিয়া প্রতিনিধি জানান, দুরদুরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার ১১৪ জন শিক্ষার্থী নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ নেয়। বিদ্যালয় ও সংশিহ্মষ্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এরমধ্যে ৩৩ জন শিক্ষার্থী পাস হয়। পরে বিভিন্ন দেনদরবারের মাধ্যমে আরো ১৭ জনকে উত্তীর্ণ ঘোষণা করে পরীক্ষার ফরম পূরণ করানো হয়। বাকি ৬৪ জন শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। নির্বাচনী পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণ ও বিশেষ ক্লাসের জন্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে আদায় করেছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের ফরম পূরণও যথাসময়ে হয়ে গেছে। অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা ফরম পূরণের সুযোগ পাওয়ার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং শিক্ষকরা অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদেরকে ফরম পূরণের আশ্বাস দেয়। ফরম পূরণের কথা বলে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা করে আদায়ও করে বলে অভিযোগ আছে। ওই সব শিক্ষার্থী জানায়, তারা নিশ্চিত হয়েছে গতকাল পর্যন্ত তাদের ফরম পূরণ না হওয়ার বিষয়ে। পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা দেড়টার দিকে মিছিল সহকারে বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে তার কার্যালয়ে আটকে রাখে। পরে খবর পেয়ে সাতকানিয়া থানা পুলিশ রাত সাড়ে ৭ টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করেন। বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র জানান, আমরা অল্প নম্বরের জন্য কয়েকটি বিষয়ে ফেল করেছি। শুরুতে আমাদেরকে ফরম পূরণের সুযোগ দেবে না বলে জানিয়ে দেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু পরবর্তীতে ৭ হাজার টাকা করে দিলে ফরম পূরণের সুযোগ পাব বলে জানান। তাই আমরা অনেক কষ্ট করে ৭ হাজার টাকা করে জমা দিয়েছি। এরপর গতকাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে আমাদের ফরম পূরণ না করায় প্রধান শিক্ষককে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখি। পরে পুলিশ এসে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আশ্বাস দেয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শংকর বসাক জানান, নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা আমাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরে পুলিশ এসে উদ্ধার করে। অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের সুযোগ না দেয়ায় তারা এমন কাজটি করেছে। এসময় তারা ভাড়াটে লোকজনও এনেছে। ফরম পূরণের আশ্বাস দিয়ে টাকা নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, আমার একার সিদ্ধান্তে তো স্কুল চলে না। সবার সিদ্ধান্ত মতে টাকা নেয়া হয়েছে। এখন আমি বিপদে পড়েছি। টাকা নেয়া হলেও এখনো অকৃতকার্য এসব শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ হয়নি বলে জানান তিনি। ফরম পূরণের সময় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, বোর্ড নির্ধারিত সময় অনুযায়ী রবিবার (আজ) ফরম পূরণের শেষ দিন। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক পার্থ সারথি চৌধুরী জানান, নির্বাচনী পরী ায় অকৃতকার্য কিছু শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করেছে। প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশ এসে যেহেতু উদ্ধার করেছে সে বিষয়ে তাদের নির্দেশনায় গুরুত্ব দেয়া হবে।

সাতকানিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো, আজিম শরীফ জানান, প্রধান শিক্ষক শংকর বসাককে অবরুদ্ধ করে রাখার বিষয়টি শুনেছি। তবে কেন অবরুদ্ধ করা হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারিনি। রবিবার আমি বিদ্যালয়ে গিয়ে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।

সাতকানিয়া থানার এসআই মো. জাহেদুল ইসলাম জানান, মূলত নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরনের আশ্বাস দিয়ে ৭ হাজার টাকা করে আদায়ের পর ফরম পূরণ না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। এদিকে ১১৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ৩৩ জন পাস করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, গত তিন চার বছর ধরে এ স্কুলে নতুন কায়দায় শিক্ষার্থীদের ফেল করানো হচ্ছে। মোহাম্মদ আবুল কাশেম নামে এক অভিভাবক জানান, এরই অংশ হিসেবে তিন ঘন্টার পরীক্ষায় দুইঘন্টা পরই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে খাতা নিয়ে নেন শিক্ষককরা যাতে শিক্ষার্থীরা ফেল করে। পরে টাকার বিনিময়ে তাদেরকে পাস করিয়ে দেয়া হয় বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, কিভাবে ফেল করানো হয়েছে তা বিভিন্ন পরীক্ষার খাতা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং নিবিড় তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে জানানোও হয়েছে দফায় দফায়। কিন্তু ফল হয়নি কোন।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মাহবুব হাসানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, অতিরিক্ত ফি নেয়ার অভিযোগটি আমাদের কাছে আসেনি। তবে এ সব অভিযোগ তদন্ত করার জন্য ইতোমধ্যে আমাদের একটি কমিটি গঠন করা আছে। কমিটি বিষয়টি তদন্ত করবে। অতিরিক্ত ফি নেয়ার অভিযোগ যথাযথ হলে জড়িতদের রেহাই পাওয়ার সুযোগ নেই।

পাঠকের মতামত: