ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ভোটের হাওয়া কক্সবাজার-৪, বদি নিয়ে বিব্রত আওয়ামী লীগ শাহজাহানেই ভরসা বিএনপির

চকরিয়া নিউজ ডেস্ক ::

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের বর্তমান এমপি আবদুর রহমান বদি। আওয়ামী লীগের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত এই সাংসদকে কেন্দ্র করে বিব্রত ও দ্বিধাবিভক্ত উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে কয়েকজন এ আসনে আসন্ন নির্বাচনে আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, দলের জেলা সহসভাপতি শাহ আলম চৌধুরী ও উখিয়া উপজেলা সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী। অন্যদিকে, সাবেক এমপি ও কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি শাহজাহান চৌধুরীই একমাত্র ভরসা বিএনপির। আসনটিতে পরীক্ষিত একক প্রার্থী থাকায় অনেকটা নির্ভারও বিএনপি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে পূর্ববর্তী এমপি শাহজাহান চৌধুরীকে পরাজিত করে নির্বাচিত হন আবদুর রহমান বদি। গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহা ইয়াহিয়াকে পরাজিত করেন তিনি। টানা দু’বারের এমপি আবদুর রহমান বদি বিতর্কিত কার্যক্রমের কারণে বার বার দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছেন। তার হাতে প্রহূত হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইনজীবী, প্রকৌশলী, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।

আবদুর রহমান বদি ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২৩ দিনের মাথায় উপজেলা নির্বাচনের দিন একটি ভোটকেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ব্যাংক কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিনকে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন। এরপর বন বিভাগের কর্মকর্তা মুজিবুল হককে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন। তার হাতে মার খেয়েছেন টেকনাফের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট রাখাল মিত্র, শিক্ষক আবদুল জলিল ও পুলিন দে। এ ছাড়াও আবদুর রহমান বদির হাতে নাজেহাল হয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হালিম ও উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলামুর রহমান, শামলাপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাস্টার আবুল মনজুর, টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া।

মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায়ও বার বার উঠে এসেছে সাংসদ আবদুর রহমান বদির নাম। সর্বশেষ দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারেও যেতে হয় তাকে। অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সম্পদের তথ্য গোপনের দায়ে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালত। ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর এই মামলায় ঢাকার সিএমএম আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর তাকে কিছু দিন কারাগারে থাকতে হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত থেকে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে না থাকলেও আবদুর রহমান বদিকে নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তার নিজের এলাকা টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশরসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতাই এই এমপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাকে বাদ দিয়েই তারা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আবার তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন দলে নবাগত ও টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদসহ নেতাকর্মীদের একাংশ। তাকে নিয়ে আলাদাভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন তারা। একই অবস্থা এই সংসদীয় আসনের উখিয়া উপজেলায়ও। এখানেও তার পক্ষে-বিপক্ষে দুটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে।

এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে আবারও দলীয় মনোনয়ন পেতে আবদুর রহমান বদিকে দলের ভেতরেই বিরোধিতা ও প্রতিকুলতার মুখোমুখি হতে হবে বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন। দলের টেকনাফ উপজেলা সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আবদুর রহমান বদির নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড এবং তার বিরুদ্ধে দুদকের করা একাধিক মামলার কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া তিনি ভোটের সুবিধার জন্য দল করছেন। তার কর্মকাণ্ড সব দলের বিরুদ্ধে। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নিজের পছন্দের প্রার্থী দিয়েছেন এই এমপি।’

অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী চকরিয়া নিউজকে আরও বলেন, ‘আবদুর রহমান বদি সরকারি টাকায় একটি জেটি করেছেন। অথচ এটি তার পারিবারিক ঘাট হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এই ঘাট দিয়ে চোরাচালানিরা সুবিধা নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে তার জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই।’ তাই অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নিজেই দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে তিনি বিকল্প প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়ার সুপারিশ করবেন।

দলের উখিয়া উপজেলা সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী  চকরিয়া নিউজকে জানান, তিনিও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তার ভাষায়, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে আগামী নির্বাচনের পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। তাই অনেক হিসাব-নিকাশ করে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে।

দলের জেলা সহসভাপতি শাহ আলম চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে জানিয়েছেন, তিনিও দলীয় মনোয়ন লাভে আশাবাদী। তার মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব খবর রাখেন। সবদিক বিবেচনা করেই তিনি দলের প্রার্থী ঘোষণা করবেন।

দলের উখিয়া উপজেলা শাখার সাবেক সভাপতি আদিল উদ্দিন চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে এই আসনে দলীয় প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। স্বচ্ছ ইমেজের ভালো প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া না হলে এই আসনে আওয়ামী লীগকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।’

বর্তমান এমপি আবদুর রহমান বদি অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, একটি মহল সব সময়ই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা কোনো দিন সফল হবে না। তিনি আরও বলেন, এলাকায় তিনি অনেক উন্নয়ন কাজ করেছেন। দলের নেতাকর্মীসহ এলাকার সাধারণ মানুষ তার পক্ষেই রয়েছে।

উখিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মাহমদুল হক চৌধুরীর নিজস্ব ভোট ব্যাংক রয়েছে। তিনি সমকালকে বলেন, তিনিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি দলের মনোনয়ন চাইবেন।

দলের উখিয়া উপজেলা সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর চৌধুরী সম্পর্কের দিক থেকে আবদুর রহমান বদির শ্যালক। বদির মনোনয়ন নিশ্চিত না হলে দলীয় মনোনয়নের দৌড়ে থাকবেন তিনি।

অন্যদিকে, এই আসনে শাহজাহান চৌধুরীর বিকল্প নেই বিএনপিতে। চার বারের এই এমপি আগামী নির্বাচনেও দলের মনোনয়ন চাইবেন। বিএনপির এই নেতা চকরিয়া নিউজকে জানালেন, সাধারণ মানুষদের নিয়ে তিনি সব সময় নির্বাচনি এলাকাতেই থাকেন। মানুষও তাকে ভালোবাসে। তিনি অতীতে অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। এলাকার মানুষ এখনও তা মনে রেখেছে। দল চাইলে তিনি আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হবেন।

শাহজাহান চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে। স্থানীয় এমপি চাইলে এই মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পারতেন। অথচ তার বিরুদ্ধেই মাদক সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে দুদকও দুর্নীতি মামলা করেছে।

এক সময়ে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে শাহজাহান চৌধুরীর জন্য বড় বাধা ছিল তার ছোট ভাই জামায়াতে ইসলামীর নেতা অ্যাডভোকেট শাহজালাল চৌধুরী। এ নিয়ে পরিবারের ভেতর দ্বন্দ্বও ছিল। তবে ভবিষ্যতে তেমন গৃহবিবাদের আশঙ্কা নেই বলে নিশ্চিত করেছেন শাহাজাহান চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, নানা কারণে শাহজালাল চৌধুরী এখন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। আগামী নির্বাচনে তার প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

অবশ্য শাহজাহান চৌধুরীর জন্য নতুন সংকট হয়ে উঠতে পারেন জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগর আমির মোহাম্মদ শাহজাহান। সম্প্রতি তিনি ঢাকায় একটি গোপন সভা করার সময় গ্রেফতার হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে এ আসনে মোহাম্মদ শাহজাহানও প্রার্থী হতে পারেন।

বিশিষ্ট শিল্পপতি মোহাম্মদ ইয়াহিয়া ও তার ছেলে তাহা ইয়াহিয়াও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের যে কোনো একজন আগামী নির্বাচনে লড়বেন বলে জানিয়েছেন গতবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণকারী তাহা ইয়াহিয়া।

পাঠকের মতামত: