ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

ওষুধে ভেজাল জীবন রক্ষা হবে কীভাবে?

আইরিন সোলতানা রুমি, চট্রগ্রাম ::

খাদ্য নিয়ে জনমনে এক ধরনের ভীতি রয়েছে। মাছ, মাংস, ফলমূল, শাকসবজি– ভেজালের হাত থেকে রেহাই নেই এর কোনোটিরই। ফরমালিন, কার্বাইড, বিষাক্ত রং, এমনকি কীটনাশকও পাওয়া যাচ্ছে খাবারে। মাছ, মাংস, দুধ, ফলমূল, শাকসবজি– সবকিছুতেই বিষের ছড়াছড়ি। বিষাক্ত রাসায়নিক মিশ্রিত এসব খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসকের কাছে এমনকি হাসপাতালে যেতেও বাধ্য হচ্ছে মানুষ। সেখানেও যে রেহাই নেই; নিরাময়ে যে ওষুধ দেয়া হচ্ছে তাতেও ভেজাল! জীবনরক্ষার নামে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে। তাহলে জীবন রক্ষা হবে কি ভাবে? নকল ও ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করায় শুধু জটিল রোগ–ব্যাধি নয়, ঘটছে মৃত্যুর মতো ঘটনাও। সাধারণ মানুষের পক্ষে কোনটি নকল আর কোনটি আসল ওষুধ তা শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণির ওষুধ কম্পানি বেশি মুনাফা লাভের আশায় তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ। এসব ওষুধ সেবন করে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে মারাও যাচ্ছে রোগী। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য। নকল হচ্ছে নামী দামি কম্পানির ওষুধও।

গত ৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাতে নগরীর পাঁচলাইশ থানার মোহাম্মদপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ উদ্ধারসহ তিন আসামিকে গ্রেফতার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। পশ্চিম ষোলশহরের সুন্নিয়া মাদ্রাসা রোডের সাইকা ফার্মেসিতে এই অভিযান চালানো হয়। গ্রেফতার হওয়া আসামিরা হলেন. মো. শহিদ উল্লাহ (৩৭), মো. শরীফুল ইসলাম মাসুদ (৩০) ও রাসেল বড়ুয়া (২২)। এছাড়া মো. জাকির নামে এক আসামি পলাতক রয়েছেন।

অভিযান পরিচালনাকারী নগর গোয়েন্দা পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর আজহারুল ইসলাম জানান, দীর্ঘদিন ধরে এ চক্রটি একটি ভালো মানের ওষুধ কম্পানির ওষুধকে বেছে নিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করে তা বাজারজাত করছে। আমরা তল্লাশিতে স্কয়ার কম্পানির ১৪৮ বক্স জাইমেক্স – ৫০০, একমি গ্রুপের ৯৮ বক্স মোনাস (আর) ১০, মন্টিলুকাস্ট ১০ মিলিগ্রাম এবং স্কয়ার গ্রশুপের ৯৪ বক্স সেকলো ২০ মিলিগ্রামসহ বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ পেয়েছি। একমি ল্যাবরেটরিজ লিমিটেডের চট্টগ্রামস্থ এরিয়া ম্যানেজার মো. সুলতান মাহমুদ এবং স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের ডিপো ম্যানেজার আবদুল মালেক গোয়েন্দা কার্যালয়ে এসে জব্দকৃত ওষুধ পরীক্ষা করে জানান, এগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নয়। গ্রেফতার হওয়া মো. শহিদ উল্লাহ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এক্‌মি, এমএসটি ফার্মা, ডেল্টা ফার্মা, ল্যাব অ্যাইড ফার্মা ও সর্বশেষ ভার্গো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে এরিয়া ম্যানেজার হিসাবে কর্মরত আছেন। তার সঙ্গে ২০১০ সালে দি একমি ল্যাবরেটরিজের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এরিয়া ম্যানেজার মো. জাকিরের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে জাকির চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন নামী–দামি কম্পানির ওষুধ নকল করা শুরু করেন। মো. শহিদ উল্লাহ পলাতক আসামি জাকিরের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ভেজাল ওষুধ এনে শরীফুলের ফার্মেসিতে মজুদ করেন। পরে রাসেল বড়ুয়ার সহায়তায় বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ ও বিপণন করে আসছিলেন। গ্রেফতার হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানায় মামলা হয়েছে।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এ চক্রের সদস্যরা একটি ভালো মানের ওষুধ কম্পানির ওষুধকে বেছে নিয়ে নিজের মতো করে তৈরি করে তা বাজারজাত করে। যেমন একটি ওষুধে এক চামচ চিনি দেয়ার কথা থাকলেও দেয়া হয় আধা চামচ ইত্যাদি। নকল ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের জেনারেশন পরিবর্তন করা হয়। বলা হলো, এটি থার্ড জেনারেশনের ওষুধ। অথচ ভেতরে দেয়া হয়েছে ফার্স্ট জেনারেশনের (প্রথম প্রজন্মের) উপাদান।

শহিদ উল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে জানান, নকল ওষুধের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যাপার ঘটে। ভেজাল ওষুধ তৈরি করে অন্য কম্পানির নামে চালানো হয়। অনেক ওষুধ কম্পানির ওষুধ প্রস্তুতের সরঞ্জাম হিসেবে ইটের গুঁড়া ও ময়দার সঙ্গে কিছু কেমিক্যাল মিশিয়েও তৈরি করে নানা ধরনের ওষুধ। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, সিরাপসহ প্রায় সব ওষুধই ভেজাল। অধিক লাভজনক হওয়ায় ওষুধ ব্যবসায়ীরা ওই ভেজাল ওষুধই খাওয়াচ্ছে রোগীদের। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ কম্পানিগুলো দেশের শীর্ষ স্থানীয় কম্পানির ওষুধের নাম ব্যবহার করেও বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বাজারে ছাড়ছে।

গত রোববার রাতে বহদ্দার হাট এলাকায় ৯ দোকানে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা জরিমানা করে র‌্যাব ও ওষুধ প্রশাসন। এর পরদিন সোমবার প্রশাসনের ওই অভিযানকে হয়রানিমূলক আখ্যায়িত করে দিনভর সব ফার্মেসি বন্ধ রাখেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন অভিযান চালিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ অভিযানে মিলছে ভেজাল সব ওষুধ। ব্যবসায়ীদের দাবি মতো যদি কোন ওষুধ ভেজাল না হয় তবে নামী–দামি ওষুধ কম্পানির নকল ওষুধগুলো যায় কোথায়? জীবন রক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে কোনধরনের ছাড় যেমন দেয়া উচিত নয়, তেমনি অভিযানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ওষুধ ব্যবসায়ীদের কোন ধরনের কর্মসূচি দেয়ারও কোন সুযোগ যাতে না থাকে সেদিকেও প্রশাসনকে কঠোর অবস্থানেই থাকতে হবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে ১৫ শতাংশ ওষুধই ভেজাল। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভেজাল ওষুধ তৈরি হয় ভারতে। এরপর নাইজেরিয়ায় ২৩ শতাংশ। এ দেশটির মোট ওষুধের মধ্যে ৪১ ভাগই ভেজাল ওষুধ। এরপরে রয়েছে পাকিস্তান যার শতকরা ১৫ শতাংশ ওষুধই ভেজাল। তবে বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। দেশের একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে শতকরা ১০ ভাগ ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। যার মূল্য ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।

পাঠকের মতামত: