ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

বিভক্তি বেড়েছে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলোতে

পার্বত্য চট্রগ্রাম প্রদিনিধি ::

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির দুই দশক আজ। পাহাড়ে চলমান সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন শান্তি বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাথে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়, যা শান্তিচুক্তি নামে পরিচিত। শান্তিচুক্তির দুই দশক উদযাপন উপলক্ষে পার্বত্য জেলাগুলোতে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দুই দশক পূর্তিতে পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র শান্তি বজায় রাখতে তাঁর সরকার বদ্ধপরিকর। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দীর্ঘদিনের জাতিগত হানাহানি বন্ধ হয়। অনগ্রসর ও অনুন্নত পার্বত্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শান্তি ও উন্নয়নের ধারা।

বিভক্তি বেড়েছে : অরণ্য আর সবুজ বনভূমির পার্বত্য অঞ্চল। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলছিল সংঘাত। পাহাড়ে হিংসার অবসান হয় ১৯৯৭ সালে। দেশ–বিদেশে আলোচিত এই চুক্তির পর গত ২০ বছরে পাহাড়িদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি বেড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে করে তাদের শক্তি ক্ষয় হয়েছে। ফলে দলগুলোর সক্ষমতাও কমেছে। বিভক্তির কারণে বাড়ছে সংঘাত।

শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) থেকে বের হয়ে প্রসীত বিকাশ খীসা, সঞ্চয় চাকমার নেতৃত্বে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) আত্মপ্রকাশ ঘটে। ওই চুক্তিকে আপোসের চুক্তি আখ্যা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফের আত্মপ্রকাশ হয়। পরবর্তীতে জেএসএস ও ইউপিডিএফের আধিপত্য রক্ষার লড়াই চলে। ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে দুই পক্ষের শত শত নেতাকর্মী খুন হন। একই সাথে চলতে থাকে অপহরণ, গুম। এছাড়া দুই পক্ষে একাধিকবার গাড়িতে হামলা, অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে হত্যার ঘটনাও ঘটে।

এর মধ্যে ২০০৮ সালের জরুরি অবস্থার মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো ও বড় আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বিভক্ত হয় পড়ে। সাবেক গেরিলা নেতা ও প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুধা সিন্ধু খীসার নেতৃত্বে গঠিত হয় জেএসএস (এমএন লারমা)। দলটি খাগড়াছড়িকেন্দ্রিক রাজনৈতিক বলয় ও প্রভাব গড়ে তোলে। শুরু হয় জেএসএস, ইউপিডিএফ এবং জেএসএসের (এমএন লারমা) ত্রিমুখী সংঘর্ষ। রাঙামাটি ও বান্দরবানে জেএসএসের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও খাগড়াছড়িতে ত্রিপক্ষীয় সংঘাতে জেএসএস অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। খাগড়াছড়ির লাগোয়া লংগদু ও বাঘাইছড়িতে সন্তু লারমার জেএসএস এবং জেএসএস (এমএন লারমা) মধ্যে সর্বাধিক সংঘাত হয়। এই তিন সংগঠনের সংঘাতের কারণে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়। জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের তিনটি দল, ওদের দ্বন্দ্ব–সংঘাতে শংকিত পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।

পাহাড়ে চলমান ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬ শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছে প্রায় সহস্রাধিক। তবে গত দুই বছর জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে অলিখিত মতৈক্য ছিল। এর ফলে সংঘাত অনেকটা বন্ধ ছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে।

এদিকে পাহাড়ে সম্প্রতি ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে নতুন আরেকটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর পর প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন দলটি দুই ভাগ হলো।

গত ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে। এতে তপন জ্যোতি চাকমাকে আহ্বায়ক ও জলেয়া চাকমাকে সদস্য সচিব করে ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) ১১ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তপন জ্যোতি চাকমা অভিযোগ করেন, পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে দলটি গড়ে উঠলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ আদর্শচ্যুত হয়েছে। এর প্রতিবাদে ইউপিডিএফ প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা সঞ্চয় চাকমা ও দিপ্তী শঙ্করসহ অনেকে দল ত্যাগ করেছেন। গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বলপ্রয়োগের রাজনীতি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও অপহরণের রাজনীতি, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের জাতীয় দিবস বর্জনের রাজনীতি, এমনকি অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রতিরোধের চেষ্টার রাজনীতি করে যাচ্ছে ইউপিডিএফ।

সংবাদ সম্মেলনে আরো অভিযোগ করা হয়, ইউপিডিএফ ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধের কথা বললেও এ পর্যন্ত ১০ জনের অধিক দলীয় নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।

এদিকে নতুন দলের আত্মপ্রকাশের পর বর্তমানে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলায় ৪টি সংগঠন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এতে করে পাহাড়ে আবারো সংঘাতের আশংকা করা হচ্ছে।

খাগড়াছড়িতে শোভাযাত্রা, কনসার্ট : পার্বত্য শান্তি চুক্তির দুই দশক পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। এর আগে পরিষদ প্রাঙ্গণে বেলুন উড়িয়ে আয়োজন উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। এর আগে অন্যদের সাথে নিয়ে দুই দশক পূর্তির কেক কাটেন তিনি।

শোভাযাত্রাটি টাউন হল প্রাঙ্গণে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক সংগঠন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন এনজিও কর্মীদের অংশগ্রহণ ছিল।

সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ফিরে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের ফলে এর সুফল পাহাড়ি–বাঙালি সকলেই পাচ্ছে।

এসময় উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুদল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. রাশেদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আলী আহমেদ খান প্রমুখ।

এদিকে শান্তিচুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে বিকালে খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয় সম্প্রীতি কনসার্টের। খাগড়াছড়ি রিজিয়ন ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আয়োজিত কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেন হায়দার হোসেন ও ব্যান্ড দল মাইলস।

পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি : পার্বত্য চট্টগ্রামকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা, পররাষ্ট্র, অর্থ, প্রতিরক্ষা ও ভারী শিল্প ছাড়া বাকি সব বিষয় পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্বাচিত স্বশাসিত সংস্থার কাছে অর্পণ করার দাবি জানিয়ে গতকাল বিকাল ৩টায় চট্টগ্রাম মহানগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে সমাবেশ করেছে পাহাড়ি তিন সংগঠন।

এতে সভাপতিত্ব করেন গণতান্ত্রিক যুবফোরাম মহানগর শাখার সভাপতি থুইক্যচিং মারমা। মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সুকৃতি চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চবি শাখার সাধারণ সম্পাদক রূপন চাকমা, পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুনয়ন চাকমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের চট্টগ্রাম মহানগরের নেত্রী মাদ্রি চাকমা। সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল মহানগরের নেতা সামিউল আলম রিচি।

পাঠকের মতামত: