ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

পার্বত্য চট্টগ্রামে দুই দশকে জনসংহতি সমিতি ভেঙে চার সশস্ত্র সংগঠন

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি ::

পার্বত্য চট্টগ্রাম। অপার সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। আয়তনে বাংলাদেশের এক-দশমাংশ। স্বাধীনতার পর স্বাধিকারের দাবিতে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন করেছে উপজাতীয়দের একাংশের একমাত্র সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। পরিবর্তন ডটকমের স্থানীয় প্রতিনিধিদের সহায়তা নিয়ে এ বিষয়ে চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এ এইচ এম ফারুক।

জেএসএস : পেছন ফিরে দেখা

চারটি দাবি নিয়ে তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একটি উপজাতীয় প্রতিনিধিদল ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

দাবিগুলো হলো- ১. পাবর্ত্য চট্টগ্রামের নিজস্ব আইন পরিষদ সংবলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হবে এবং এর একটি নিজস্ব আইন পরিষদ থাকবে। ২. উপজাতীয় জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুরূপ সংবিধি বাংলাদেশের সংবিধানে সংযোজন করা। ৩. উপজাতীয় রাজাদের দফতরগুলো সংরক্ষণ করা এবং ৪. সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের সংশোধন-নিরোধসংক্রান্ত বিধি রাখা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আরেকটি রাষ্ট্রের আদলে প্রদেশ করার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১৬ মে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)।

দীর্ঘ সময় বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে অবসান হয় সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলন। দেশে-বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিটি শান্তিচুক্তি হিসেবেও পরিচিতি পায়।

কিন্তু চুক্তির দীর্ঘ দুই দশক পরও পাহাড়ে শান্তি ফিরেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সময়ের পরিক্রমায় জনসংহতি সমিতি ভেঙে দুই সংগঠনের চারটি পৃথক গ্রুপ জন্ম নিয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখতে খুন, গুম, অপহরণ এবং নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে চলে ভ্রাতৃঘাতি অন্তর্দ্বন্দ্ব।

দুই দশকে ভেঙে চার সংগঠন

পার্বত্য চুক্তির আগে জেএসএস একমাত্র সংগঠন ছিল, যারা পাহাড়ে চাঁদাবাজি করতো। চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতে খুন, গুম, অপহরণ ছিল তাদের কৌশল। ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর কৌশলগত কারণে তারা ভেঙে দুই ভাগ হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন চাই’ স্লোগান নিয়ে ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে নিজেদের জানান দিয়ে ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীতে সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় নতুন সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। কিন্তু তাদের লক্ষ্য পরিবর্তন হয়নি।

জনসংহতি সমিতি একটি অংশ নিয়ে সরকারের সাথে সমঝোতা করলেও তাদের আগের দাবিগুলো নিয়েই মাঠে রয়ে যায় ইউপিডিএফ। সরকারের নানা সুবিধা নিয়ে চলা জেএসএস এবং সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন ইউপিডিএফ উভয় সংগঠনই সমান তালে চালাচ্ছিল আগের মতো চাঁদাবাজি।

এর মাঝে ২০১০ সালের এপ্রিলে অর্থ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ভাঙনের কবলে পড়ে সন্তু লারমা নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এমএন লারমা) মৃত্যুর পর সংগঠনের প্রধান হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন সন্তু লারমা। তারা পরস্পর সহদোর।

অভিযোগ রয়েছে, তখন থেকেই চাঁদাবাজির মাঠে যুক্ত জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) গ্রুপ, যারা জেএসএস সংস্কার নামেই অধিক পরিচিত। জেএসএসের আরেক শীর্ষ নেতা সুধাসিন্দু খীসা রয়েছেন এ অংশের নেতৃত্বে।

আর গঠনের ১৯ বছরের মাথায় এসে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ভাঙনের মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামে সংগঠনটি ‘ইউপিডিএফ সংস্কার’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে।

এ সংগঠনটি সবেমাত্র জন্ম নেয়ায় এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। তবে তাদের নেতাদের নামে আগে থেকেই রয়েছে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই সংগঠনগুলোর মধ্যে বর্তমানে সরকারিভাবে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস শক্ত অবস্থানে থাকলেও স্থানীয়দের মাঝে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের নাম ইউপিডিএফ। কিছু কিছু এলাকায় চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে ‘জেএসএস সংস্কার’ও কম এগিয়ে নয়। অস্ত্র কেনা, সামরিক কায়দায় নিয়োজিত সশস্ত্র সদস্যদের বেতন, নেতাদের আরাম-আয়েস এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম, সরকার তথা রাষ্ট্র নিয়ে বিবিধ অপপ্রচার- এই চার গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় করা হয় তাদের চাঁদাবাজির বেশিরভাগ টাকা।

নেতারা যা বললেন

এ বিষয়ে জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) শীর্ষ নেতা সুধাসিন্ধু খীসা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে ঐহিতাসিক চুক্তি সম্পাদন করেছে। কিন্তু সন্তু লারমা অর্থনৈতিক সুবিধা ও পদ-পদবী নিয়ে সেই চুক্তি বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকা রাখছেন না। তার স্বৈরাচারী চরিত্র প্রকাশ পাওয়ায় বাধ্য হয়ে আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার (এমএন লামরা) আদর্শে সন্তু বাবুর নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসেছি।

ইউপিডিএফের মুখপাত্র নিরণ চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, আমাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে পিছিয়ে এসে সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতি সরকারের সাথে আপোস করেছে। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে নতুন সংগঠন তৈরি করতে হয়েছে। আমরা এখনো আমাদের স্বাধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।

ইউপিডিএফ ভাঙার বিষয়ে তিনি বলেন, এরা দলছুট। তারা রাষ্ট্রীয় মদদে নব্য মুখোশ-বোরকা বাহিনী।

‘গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ তথা ইউপিডিএফ সংস্কার’-এর আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা (বর্মা) পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ইউপিডিএফের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক, বলপ্রয়োগের রাজনীতি, চাঁদাবাজি, গুম, খুন ও অপহরণের রাজনীতি করছেন প্রসিত খীসা। ইউপিডিএফের অনেক নেতা চাঁদার টাকায় এখন ‘পকেট ভারী নেতা’ হিসেবে পরিচিত।

‘মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি হয়ে প্রসিত খীসার ইউপিডিএফ এখন নীতিহীন, আদর্শহীন, লক্ষ্যভ্রষ্ট ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। আর এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীদের আর্থিক দণ্ড এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছেন তারা।’

তিনি বলেন, বর্তমানে ইউপিডিএফের আন্দোলন পরিচালনার কৌশল ও পদ্ধতি সঠিক না হওয়ার কারণে ইউপিডিএফের কেন্দ্রীয় নেতা সঞ্জয় চাকমা ও দীপ্তি শংকরসহ অনেকে দল ত্যাগ করেছেন। এছাড়া দল ত্যাগ করার অপরাধে অনেক নেতাকর্মীকে খুন করেছে প্রসিত খীসার সন্ত্রাসী বাহিনী।

তাই সংগঠনে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আমরা প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ গঠন করেছি।

এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য চেষ্টা করা হলেও জনসংহতি সমিতির (সন্তু গ্রুপ) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র নারায়ণ লারমা ওরফে সন্তু লারমার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেএসএসের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ও মুখপাত্র সজীব চাকমা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘স্বার্থ ও অসৎ উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক দলের ভাঙন সৃষ্টি করছে কায়েমি গোষ্ঠী। নিজেদের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিলম্ব করছেন তারা। সরকার চুক্তিতে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই এমন হচ্ছে।’

পাঠকের মতামত: