ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাশেদাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

রহস্যময়ী নারী রাশেদাকে গ্রেফতার করতে পারলেই উন্মোচিত হবে তরুণ আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পী খুনের রহস্য। তাই তাকে গ্রেফতারে হন্যে হয়ে উঠেছে পুলিশ। এ নারীর সাথে নিহত বাপ্পীর সম্পর্ক গভীর ছিল, তাতে সন্দেহ নেই পুলিশের এবং এটাও নিশ্চিত যে তাদের দু’জনের মধ্যে মামলা, জেল ইত্যাদি নানা ঘটনায় সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে চলে গেলেও সম্প্রতি সে সম্পর্ক আবারো মধুর হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এখানেই বাপ্পী বড় ভুল করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। কিন্তু সম্পর্ক পুনরুদ্ধারটা যে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ বিশেষ, তা বুঝতে গিয়ে চরম মূল্য দিতে হলো বাপ্পীকে।

এ প্রসঙ্গে সিএমপির কোতয়ালী জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মো. জাহাঙ্গির আলম বলেন, বলার মতো নতুন কোনো কিছু এখনো হাতে আসে নি। তবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, হত্যাকাণ্ডে যে বা যারাই থাকুক না কেন, রাশেদা নামের ঐ মহিলা ছিল। এখন তাকে গ্রেফতার করতে পারলেই হত্যার কারণ, পরিকল্পনায় কে কে ছিল এবং ঘটনায় ক’জন জড়িত ছিল– সব কিছু জানা যাবে।

প্রসঙ্গত: গত শনিবার দুপুরে নগরীর চকবাজার থানার পশ্চিম বাকলিয়া কেবি আমান আলী সড়কের বড় মিয়া মসজিদ এলাকার এনইউ ভবনের নিচতলার একটি কক্ষ থেকে ওমর ফারুক বাপ্পীর হাত–পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন বাপ্পী। আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহ–সভাপতি ও বান্দরবান জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য ছিলেন। এ ঘটনায় গত শনিবার রাতে চকবাজার থানায় বাদি হয়ে হত্যা মামলা করেছেন বাপ্পীর বাবা আলী আহমদ। এতে রাশেদা বেগমকে প্রধান এবং অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশের গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের জাকির হোসেনের মেয়ে রাশেদা বেগম। তবে রাশেদার ঠিকানা চকরিয়া লিখলেও অনেকে তাকে রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ করেন। বাপ্পীর আগে দেলোয়ার হোসেনকে বিয়ে করেছিল সে। আদালত পাড়ায় ইয়াবা নারী হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। তার সাবেক স্বামী দেলোয়ারও ইয়াবা বিক্রেতা। সে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া থানার মুশারপাড়া গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে। ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর কল্পলোক আবাসিক এলাকা থেকে দুইশ পিস ইয়াবাসহ দেলোয়ার হোসেন ও রাশেদাকে গ্রেফতার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলায় দুজনই কয়েকমাস জেল খাটে। সেসময় তাদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেছিলেন বাপ্পী। এক সময় ওই নারীকে জামিনে বের করে আনেন বাপ্পী। কিন্তু তার স্বামী তখনও জামিন পায়নি। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতে আসা–যাওয়ার সুবাদে বাপ্পীর সাথে ‘কৌশলে’ ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলে রাশেদা। তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে একপর্যায়ে রাশেদাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন বাপ্পী।

গোয়েন্দা সূত্রটি আরো জানায়, রাশেদার মতো তার মায়েরও একাধিক বিয়ে হয়েছিল। সর্বশেষ যে কাজী রাশেদার মায়ের বিয়ে পড়ান, সেই কাজীই বাপ্পীর সাথে রাশেদার বিয়ে পড়ান।

জানা যায়, ২০১৫ সালের দিকে বাপ্পীর সাথে বিয়ে হয় রাশেদার। বাপ্পীকে বিয়ে করায় ক্ষুদ্ধ হয় দেলোয়ার হোসেন। তার বিশ্বাস ছিল বাপ্পীই তার স্ত্রীকে ফুসলিয়ে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি পাঁচলাইশ থানায় রাশেদা বেগম বাদি হয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের অভিযোগ এনে মামলা করে। গত ৫ ফেব্রুয়ারিতে বাপ্পীকে গ্রেফতার করে পাঁচলাইশ থানা পুলিশ। পরে আদালত থেকে জামিন পান তিনি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে কোতোয়ালী থানায় বাপ্পীও নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছিলেন। এ মামলায় রাশেদা ১৭ দিন জেল খাটে। পরে তিন লাখ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসা করেন বাপ্পী। বাপ্পীর দায়ের করা একাধিক মামলায় জেল খাটার পর রাশেদা সাবেক স্বামী দেলোয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এদিকে রাশেদার মামলা চলাকালীন সময়ে হঠাৎ করে আইনজীবী বাপ্পীকে হেয় করে নগরীর বাকলিয়া, ডিসি রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় একটি পোস্টার চোখে পড়ে। পোস্টারে স্ত্রী রাশেদা বেগম ও বাপ্পীর বিয়ের ছবি ছাড়াও গ্রেফতারের পর রশি দিয়ে বাপ্পীর কোমরবাঁধা ছবিসহ দুটি ছবি দেয়া হয়। তখন কারো বুঝতে বাকি ছিল না যে, রাশেদাই এই পোস্টারের মুদ্রণকারী। সূত্র মতে, এসবের পরও রাশেদার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন বাপ্পী।

সিএমপির গোয়েন্দা শাখার এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমার ধারণা রাশেদার প্রাক্তন স্বামী দেলোয়ার যে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে তা বাপ্পী জানতেন না। দেলোয়ারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাসা নেয়া থেকে বাপ্পীকে আমন্ত্রণ জানানো সব হয়েছে। রাতের খাওয়ারের সাথে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোয় কোনো ধরনের শব্দ হয়নি। কারণ এত বড় ঘটনা ঘটে গেলেও পাশের ঘরে কোনো শব্দ শোনা যায়নি। তিনি আরো জানান, রাশেদার সাথে দেলোয়ারও ঘটনায় জড়িত বলে সন্দেহ হচ্ছে। আমরা তাকে ধরার জন্য কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম। তবে সে সিম পরিবর্তন করায় একটু সময় লাগছে।

আইনজীবী ওমর ফারুক বাপ্পীর লাশ উদ্ধারের পরপরই নগরীর বাদুরতলা বড় গ্যারেজ এলাকার আলম ভিলাস্থ রাশেদা বেগমের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরপরই রাশেদা বেগম পালিয়ে গেছে বলে জানান নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা। যে বাসা থেকে শনিবার বাপ্পীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে সেটি তিনদিন আগে ভাড়া করেছিলেন এক নারী। বাসা ভাড়া নেওয়া ওই নারী রাশেদা বলে ধারণা করছে পুলিশ।

এদিকে আইনজীবী ওমর ফারুক ওরফে বাপ্পীর সহকারি আসাদ খানকে শনিবার দুপুরে পিবিআই কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পিবিআই পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, এই ঘটনাটি আমরাও তদন্ত করে দেখছি। আসামি গ্রেফতারের পর সবকিছু স্পষ্ট হবে।

পাঠকের মতামত: