ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

চট্টগ্রামে মরণ নেশা ইয়াবা আসছে স্রোতের মত

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি :  বর্তমানে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে ইয়াবার বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। মায়ানমার হতে টেকনাফ কক্সবাজার হয়ে অবাধে চট্টগ্রামে প্রবেশ করছে মরণনাশক ইয়াবা। বাস, ট্রাক, প্রাইভেট গাড়ি ও সাগর পথে আনা হচ্ছে এসব ইয়াবা। এখানে বাজারের চাহিদা মেটানোর পর সারাদেশে অনায়শে পাচার করা হচ্ছে। নগরীতেও ইয়াবা সহজলভ্য। মাদক স্পটগুলো ছাড়াও পান দোকান, চা-দোকানসহ সর্বত্রই পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। ক্রেতা-বিক্রেতারা ইয়াবাকে সংক্ষেপে ‘বাবা’ নামেই ডাকে।

প্রতিদিনই এলিট ফোরস, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করছে ইয়াবা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ইয়াবা পাচার বা ব্যবহার বন্ধ হচ্ছেনা। ইয়াবা চোরাচালানিরা অপ্রতিরোধ্য। গ্রেপ্তারকৃতরা জানিয়েছে, প্রতি মাসে চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশে অন্তত ৪৫ কোটি টাকার ইয়াবা পাচার করা হয়। চট্টগ্রাম নগরীতে বাজারজাত করা হয় আরো ১৫ কোটি টাকার ইয়াবা।

অভিজাত শ্রেণীর সন্তানরাও এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই ইয়াবা পাচার ও ব্যবসা চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। চুনোপুটিরা গ্রেপ্তার হলেও রাঘব বোয়ালরা রয়ে গেছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ইয়াবা পাচার রোধে ‌র্যাবের চকরিয়া ক্যাম্পটি কক্সবাজার সদরে স্থানান্তর করা হয়েছে। পুলিশ ও এলিট ফোরস সুত্র জানা যায়, নগরী এখন ইয়াবার অবাধ হাটে পরিণত হয়েছে। অলি-গলি, ফার্মেসি, বস্তি, চা-দোকান, পান দোকানসহ সবখানে ইয়াবা বিকিকিনি করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫ সালের দিকে ইয়াবা ব্যবসা শুরু হয় বাংলাদেশে। তখন খুব কম পরিমাণ ইয়াবা দেশে প্রবেশ করত। দুবাই, সিঙ্গাপুর ভিত্তিক সিন্ডিকেট ইয়াবা পাচারের সাথে জড়িত ছিল। সে সময় যৌন উদ্দীপক ঔষধ হিসেবে এগুলো সেবন করত বিত্তশালীরা। তখন প্রতিটি টেবলেটের দাম ছিল ১৫০০ হতে ২৫০০ টাকা।

নাম করা ফার্মেসীতে ইয়াবা বিকিকিনি হত। খুব গোপনে বিমান যোগে আনা হত ইয়াবা। বিকিকিনিও করা হত সতর্কতার সাথে। দীর্ঘ ৫ বছর এভাবেই বিকিকিনি চলে। ২০০০ সাল থেকে ইযাবা সরবরাহ বাড়তে থাকে। মায়ানমার হতে টেকনাফ- কক্সবাজার হয়ে চট্টগ্রামে আসতে থাকে ইয়াবা। চোরাই পথে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আসতে থাকে চট্টগ্রাম নগরীতে। ২০০৩ সাল থেকে তা অবাধে আসা শুরু করে। হাজার হাজার ইয়াবা ‌ট্যাবলেট প্রবেশ করতে থাকে প্রতিদিন। দামও আগের তুলনায় অনেক কমে যায়। বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী ও বাহকরা পুলিশকে জানায়, বিগত ৭/৮ বছর যাবত অবাধে ইয়াবা আসছে চট্টগ্রামে। মায়ানমারের সিন্ডিকেটগুলো পেকেট ভর্তি করে ইয়াবা টেকনাফ সীমান্ত পার করে এদেশীয় সিন্ডিকেটের হাতে হস্তান্তর করে।

তারা এসব ইয়াবা কক্সবাজার সিন্ডিকেটকে দেয়। তাদের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মূল সিন্ডিকেটের হাতে এগুলো পৌঁছে যায়। মূল সিন্ডিকেট নগরী ও দেশের বিভিন্ন এলাকার পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করে। তারা আরো জানায়, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে দেড় শতাধিক বাহক রয়েছে। তাদের মধ্যে মহিলা এবং শিশুও আছে। এসব বাহকরা ট্রাক, বাস, মাই্ক্রবাস, প্রাইভেট কার যোগে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। মহিলারা বোরকার ভেতর করেও পাচার করে ইয়াবা। ট্রাকে মালামালের ভেতরে ইয়াবা রাখা হয়। জুতার ভেতর বা শরীরের সাথে বেঁধে ইয়াবা নিয়ে আসে বাহকরা। বাসে যাএি বেশে ইয়াবা নিয়ে আসে বাহকরা। কিছু বাসের চালক, হেলপার এতে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামে আনার পর নিধারিত হোটেলে অবস্থান করে তারা।

রাতে সেখানে উপস্থিত হয় মূল সিন্ডিকেটের লোকজন। সেখানে লেনদেন শেষে উভয় পক্ষ সরে পড়ে। মূল সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্রেতারা ইয়াবা কিনে নিয়ে যায়। তারা ট্রেন বা বাসযোগে এগুলো নিজ এলাকায় নিয়ে যায়।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রতি মাসে অন্তত ১৫ লাখ ইয়াবা চট্টগ্রাম হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার হয়। যার মূল্য ৪৫ কোটি টাকা। নগরীতে সরবরাহ করা হয় আরো ৫ লক্ষাধিক ইয়াবা। যার বাজার মূল্য ১৫কোটি টাকা। নগরীর শতাধিক পাইকারি ব্যবসায়ীর কাছে এসব টেবলেট সরবরাহ করে তারা। গ্রেপ্তারকৃত ব্যবসায়ীরা জানায়, দাম আগের তুলনায় অনেক কম। এক সময় প্রতিটি ট্যাবলেট ১৫০০ হতে ২৫০০ টাকায় বিকিকিনি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫০ থেকে৩০০ টাকায়। পাইকারি বাজারে বড় ইয়াবার দাম ১১০ হতে ১৩০ টাকা।

জানা যায়, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অভিজাত ঘরের সন্তানরাই এর ক্রেতা। বিক্রির সাথেও জড়িত রয়েছে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানরা। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়ন রত ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে ধণাঢ্য ব্যসায়ীরাও ইয়াবা সেবনে ঝুঁকে পড়েছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজনও কিনছে। ইয়াবা ট্যাবলেটকে ‘বাবা’ নামেই ডাকে ক্রেতা- বিক্রেতারা। গ্রেপ্তারকৃতরা পুলিশকে আরো জানায়, অভিজাত শ্রেণীর লোকজন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। তারা মূল সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছ থেকে কিনে নেয়। এরপর পরিচিতদের কাছে বিক্রি করে।

খুলশী, সুগন্ধা, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি, সিডিএ আবাসিক, আকবরশাহসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ইয়াবা বিকিকিনি হয়। পুলিশ ইয়াবা ট্যাবলেট বিকিকিনিকালে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও গ্রেপ্তার করতে দেখা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি স্তরের কর্মকর্তারা প্রায় অভিযান চালালেও রহস্যজনক ভাবে চুনোপুটিরা ধরা পড়ে। রাঘব বোয়ালরা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। তবে পুলিশ বলছে বিক্রি ও পাচার উভয় দিকেই আমাদের নজর রয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, অপ্রতুল লোকবল নিয়ে আমরা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই। নিয়মিত উদ্ধার হচ্ছে মাদক। মরন নেশা ইয়াবা চোরাচালান ও মাদক রোধে আমরা সব সময় সচেষ্ট। রাশ/চগ

পাঠকের মতামত: