ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন ডিসেম্বরে দৃশ্যমান হচ্ছে নির্মাণকাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

কক্সবাজারে রেলস্টেশন এবং দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে আগামী মাসে। প্রথমে রেললাইন হবে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত।
রামু হবে জংশন। সেখান থেকে একটি লাইন চলে যাবে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার থেকে আরেকটি লাইন পূর্ব দিকে যাবে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুমে। ২০২২ সালের মধ্যে রেললাইনের কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণের ‘রুট এলাইনমেন্ট’ চূড়ান্ত হওয়ার পর এবার চূড়ান্তভাবে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অধিগ্রহণের যেসব জায়গায় স্থাপনা রয়েছে তা উচ্ছেদসহ পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে কক্সবাজারের চকরিয়ায় এডিবি ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের যৌথদল অধিগ্রহণকৃত যেসব জায়গায় স্থাপনা রয়েছে, সেসব স্থান পরিদর্শন এবং স্থাপনা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘‘দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের ‘রুট এলাইনমেন্ট’ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন চলছে রেলপথের ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। এ কারণে যেসব জায়গায় স্থাপনা রয়েছে তা উচ্ছেদসহ রিপ্লেসমেন্ট (পুনর্বাসন) করার প্রক্রিয়াও হাতে নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
’’

তিনি জানান, চকরিয়ার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ভবনের উপর দিয়ে যাবে রেললাইন। তাই বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সচল রেখে কীভাবে রেললাইন নির্মাণ করা যায় সেজন্য এডিবি ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচ্চ পর্যায়ের যৌথদল সরেজমিন পরিদর্শনে আসেন গত বুধবার। এ সময় প্রতিনিধিদল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেছে, রেললাইনের নীতিমালা অনুযায়ী পালাকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন স্থানান্তরসহ পাশের জায়গায় নতুন করে ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হবে। নতুন ভবন নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান ভবনের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম চালু থাকবে। তাই আপাতত রেললাইনের উপর পড়া ভবনটি ভাঙা হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত রেললাইনের ‘রুট এলাইনমেন্ট’ পিলার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন জোরেশোরে চলছে রেললাইনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। উঁচু-নিচু টিলা, বনভূমি ও সমতল সবুজ প্রান্তর পেরিয়ে রেললাইনটি শেষ হবে সমুদ্রতীরের একেবারে কাছে। এ জন্য ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের অনাপত্তি পত্রও চূড়ান্ত করে ফেলা হয়েছে। ওই রুটে ১৪০ কিলোমিটার নতুন ‘ডুয়েল গেজ’ রেললাইন নির্মাণ করা হবে। বনভূমির যেসব স্থানে বন্যপ্রাণী ও হাতির বিচরণ এলাকা, সেসব স্থান চিহ্নিত করে ‘প্যাসেজ’ নির্মাণ করা হবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত থাকবে ৯টি রেলস্টেশন। এগুলো হলো দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, হারবাং, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ইসলামাবাদ, রামু ও কক্সবাজার। তবে কক্সবাজারের প্রস্তাবিত রেলস্টেশন এলাকা এখনো ধানিজমি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চৌধুরীপাড়ার ওই স্থান চিহ্নিত করে রেখেছে। রামু থেকে চৌধুরীপাড়ায় কক্সবাজার স্টেশনে আসতে লাইনের দুটি স্থানে সড়ক ক্রসিং থাকবে। প্রথমভাগে (লট-১) দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ট্র্যাক নির্মাণ, রেলের সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন কাজ করা হবে। দ্বিতীয়ভাগে (লট-২) চকরিয়া থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্র্যাক নির্মাণ এবং কক্সবাজার রেলস্টেশন নির্মাণ করা হবে।

চলতি বছরেই রেলস্টেশন ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের নির্মাণকাজ শুরু হতে পারে। প্রথমে রেললাইন হবে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত। রামু হবে জংশন। আর সেখান থেকে একটি লাইন চলে যাবে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে। তখন ঢাকা থেকে সরাসরি রেলযোগে পৌঁছানো যাবে কক্সবাজারে। পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার থেকে আরেকটি লাইন পূর্ব দিকে যাবে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুমে। ২০২২ সালের মধ্যেই বহুল প্রতীক্ষিত এই রেললাইনের কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে।

এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রেল নেটওয়ার্ক ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হবে বাংলাদেশের রেলপথ। এতে রেল নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি লাভ করবে মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-ইরান হয়ে ইউরোপের তুরস্ক পর্যন্ত।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আটটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি। তাই এ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশি পর্যটকদের রেলপথে বাংলাদেশ তথা পর্যটননগরী কক্সবাজারে আসার সুযোগ অবারিত হবে।

ওই প্রকল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনার মধ্যে থাকবে কক্সবাজারে ঝিনুক আকৃতির রেলস্টেশন। বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে নির্মিত হবে আন্তর্জাতিক মানের রেলস্টেশনটি। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য দৃষ্টিনন্দন আন্তর্জাতিক এ রেলস্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঝিনুক আকৃতির এই রেলস্টেশন দেখলে পর্যটকেরা বুঝতে পারবে এটি সমুদ্রসৈকতের রেলস্টেশন। স্টেশনটির অবস্থান হবে কক্সবাজার বাস টার্মিনালের উত্তর-পশ্চিমের চৌধুরীপাড়ায়।

দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন সমপ্রসারণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে চারটি যোগ্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে। ইতোমধ্যে তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের কিছু স্থানে তাঁরা জরিপকাজ শুরু করেছেন। এই প্রকল্পের দৃশ্যমান কাজ শুরু হতে পারে আগামী ডিসেম্বরে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ১০০ কিলোমিটার রেলপথ ২০২২ সালের মধ্যেই শেষ হতে পারে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্র জানায়, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে দোহাজারী-রামু ৮৮ কিলোমিটার, রামু-কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এবং পরে রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। তবে ২০২২ সালের মধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ করার জন্য জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত করা হয়েছে ১ হাজার ৩৯১ একর। সেখানে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় ৩৯১ একর এবং কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, রামু ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ১০০০ একর রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।

সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পের দোহাজারী থেকে চকরিয়া (লট-১) পর্যন্ত কাজ করবে চায়না কম্পানি সি ও টি গ্রুপ। আর চকরিয়া থেকে কক্সবাজার (লট-২) পর্যন্ত করবে সিসিইসিসি ও ম্যাক্স গ্রুপ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার সদর ও চন্দনাইশ এলাকার অধিগ্রহণকৃত জমি ইতোমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে রেলপথ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ওই দুই এলাকায় কম্পানিগুলো জরিপকাজ শুরু করে দিয়েছে।

পাঠকের মতামত: