ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

আজিমপুরে আ’লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ‘রণক্ষেত্র’

স্টাফ রিপোর্টার : কর্মসূচিস্থলে ময়লার স্তুপ থাকার জেরে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে রাজধানীর আজিমপুর পার্ল হারবার কমিউিনিটি সেন্টারের সামনের এলাকা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ‘১৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নাগরিক সমাবেশ উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা এবং সদস্য পদ নবায়ন, প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ’ লক্ষে বর্ধিত সভাস্থলে এ ঘটনা ঘটে।  সংঘর্ষের সময় প্রায় ২০টি মোটর সাইকেলে আগুন দেয়া হয়। এসময় কয়েকটি গাড়িও ভাংচুর করা হয়। এঘটনায়  ১৩ জনকে আটক করে পুলিশ।  সংঘর্ষ চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত আজিমপুর এলাকায় যান চলাচল বন্ধ থাকে।

সূত্র জানায়, পুরান ঢাকার দুই আওয়ামী লীগ নেতার দ্বন্দ্বের জেরে তাদের কর্মী-সমর্থকরা আজিমপুর এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়েছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে বেশ কিছু যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ঢিল ছাড়াছুড়ির মধ্যে ঘটনার সূত্রপাত হয় আজিমপুর রোডের পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের অনুষ্ঠানস্থলের সামনে ময়লা ফেলাকে কেন্দ্র করে। বৃহস্পতিবার সকালে সেই কমিউনিটি সেন্টারে কামরাঙ্গীর চর, লালবাগ ও কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন মুরাদ।

অন্যদিকে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফিকে ‘লাঞ্ছিত’ করার প্রতিবাদে তার অনুসারীরা একই সময়ে আজিমপুর রোডে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

বৃহস্পতিবার সকালে এলাকাবাসী ঘুম থেকে উঠে দেখতে পান কমিউনিটি সেন্টারের সামনে জমে আছে ময়লার পাহাড়। মুরাদের সমর্থকরা সকালে সেখানে এসে ময়লার স্তুপ দেখে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে শুরু করেন।

খবর পেয়ে পুলিশও ঘটনাস্থলে যায়, পুরো এলাকায় নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। কিন্তু বেলা ১১টার দিকে মেয়রপন্থি আওয়ামী লীগ কর্মীরা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে আজিমপুর রোডে ঢুকতে চাইলে শুরু হয় গন্ডগোল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খান বলেন, “ওই রোডে তাদের বিক্ষোভ সমাবেশের কোনো অনুমতি ছিল না। পুলিশ তাদের বাধা দিলে তারা ঢিল ছুড়তে শুরু করে। পরে পুলিশ তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় পলাশীর মোড়ে দুই পক্ষের ২০টি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই পরিস্থিতি ছিল থমথমে। এর মধ্যে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আওয়ামী লীগের দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। পুলিশ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে শুরু হয় ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ। এ সময় আজিমপুর এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আজিমপুর চৌরাস্তা, পলাশী, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ এতিমখানা রোডের পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

আজিমপুর চৌরাস্তায় পুলিশ অবস্থান করলেও ভেতরের রাস্তাগুলো দিয়ে পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারের সামনে বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলে জানান একাধিক প্রত্যক্ষ্যদর্শী।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মেয়র সাঈদ খোকন এবং শাহে আলম মুরাদের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই দ্বন্ধ চলছে।

গত ২৬ অক্টোবর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে ওঠা নিয়ে দুই পক্ষের কর্মী সমর্থকরা হাতাহাতিতে জড়ালে দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পায়।এর জের ধরে ১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বর্ধিত সভায় মুরাদের সমর্থকদের সঙ্গে মান্নাফির অনুসারীদের ফের হাতাহাতি হয়।

বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর শাহে আলম মুরাদের বলেন, “আমরা সদস্য সংগ্রহ ও নবায়নের অনুষ্ঠান করছি। সেখানে কেনই বা ডাস্টবিনের ময়লা দিয়ে আটকে দেওয়া হল, তারপর আবার কেন পুলিশের সাথে মারামারি করেছে- এটা বুঝতে পারছি না।

সাঈদ খোকনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ঢাকা ২৬ নাম্বার ওয়ার্ড কাউন্সিল হাসিবুর রহমান মানিককে ইঙ্গিত করে মুরাদ বলেন, “ওখানকার এক কমিশনারসহ কিছু লোক পুলিশের সাথে মারামারি করেছে বলে আমি খবর পেয়েছি। এমনকি দীপুমনি আপার গাড়িতেও আঘাত করেছে। যারা আওয়ামী লীগ করে তারা কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

এ বিষয়ে হাসিবুর রহমান মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমাদের কোনো লোকজন ওখানে মারামারি করতে যায়নি। আমাদের লোকজন আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে ছিল। দীপুমনি আপার গাড়িতে যারা ঢিল ছুড়েছে এবং ভাংচুর ও পোড়ানোর কাজ করেছে তারা উনাদের(মুরাদ) লোক। আমি ওয়ার্ড কমিশনার, আমার লোকজন কেন মারামারিতে যাবে?”

এর আগে মুরাদের অনুষ্ঠানস্থলের সামনে ময়লা ফেলার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি বলেন, “ময়লার মালিক তো আর আমি না। অনেক সময় গাড়ির সঙ্কট থাকেৃ অনেক জায়গায় ময়লা জমে থাকে। হয়ত সরিয়ে নিয়ে যাবে। আসলে তারা বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা করে।

এর আগে হাতাহাতির দুটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে মান্নাফি বলেন, “একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করেছে। উনারা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা, আমিও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা। এর প্রতিবাদে আমরা কর্মসূচি দিতেই পারি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা  জানান, ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে পরিছন্ন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে রাতের বেলায় দুই ট্রাক ময়লা ফেলে যাওয়ার পর থেকেই দুর্গন্ধে কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। পাশেই ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখা। এই ঘটনার জেরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কমপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চলমান দ্বন্দ্ব শুভকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আজ যেভাবে অনৈক্য দেখাচ্ছেন, তা কখনো শুভকর নয়। এভাবে চললে আগামীতে আমাদের সরকার ক্ষমতায় আসবে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আজিমপুরে পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক বর্ধিত সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় আজিমপুরে পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে বর্ধিত সভা আয়োজন করা হয়। ১৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নাগরিক সমাবেশ সফল করা এবং নতুন সদস্য সংগ্রহের জন্যই এই সভা ডাকা হয়। কিন্তু এই সভা বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কমিউনিটি সেন্টারের গেটে ময়লা ফেলে চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ময়লা কিছুটা সরিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে প্রবেশ করে নির্ধারিত সভা আরম্ভ করে দক্ষিণের নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে সামনে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনের সমর্থকরা দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদের বহিষ্কারের দাবিতে মিছিল করে।

এ প্রসঙ্গ টেনে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আপনারা যে বলেন শেখ হাসিনার সরকার, বারবার দরকার। কিন্তু কীভাবে দরকার? ঐক্য ছাড়া শেখ হাসিনার সরকার আসবে না। ঐক্যের কোনো বিকল্প নাই। আজ যে দ্বন্দ্ব চলছে, এভাবে চলতে থাকলে শেখ হাসিনার সরকার আসবে না। তিনি আরো বলেন, একাত্তরের ঘাতকদের নির্মূল করা জন্য আমাদের ঐক্য দরকার। ঘাতকদের এ দেশ থেকে বিতারিত করতে হলে ঐক্য থাকতেই হবে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন প্রমুখ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মহানগর দক্ষিন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা অভিযোগ করেছেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে মেয়র সাঈদ খোকন কাউন্সিলর মান্নাফি, ফরিদ উদ্দিন রতন ও হাসিবুর রহমান মানিককে দিয়ে ষড়যন্ত্রের ছক বাস্তবায়ন করছেন। এরই অংশ হিসেবে ২৬ অক্টোবর ফ্লাইওভার উদ্বোধনের দিন, ১ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে বর্ধিত সভা এবং সর্বশেষ গতকালের দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান এবং ১৮ তারিখের জনসভাকে সফল করার প্রস্তুতি সভার ব্যাঘাত ঘটাতে কাউন্সিলর মান্নাফি সামনে থেকে লিড দিয়েছে। যাতে কিছু একটা ঘটনা ঘটলেই মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্চিত করা হয়েছে-মর্মে অপবাদ দেওয়া সহজ হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ওই এলাকার কাউন্সিলর মান্নাফি নয়। কেন তিনি আজিমপুরে গেলেন?

তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ৩৮নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু আহমেদ মুন্নাফী ময়লার স্তুপ রাস্তায় ফেলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ মুক্তিযোদ্ধা লাঞ্ছনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে। তারা মুরাদের পদত্যাগ চায়। কিন্তু মুরাদ পুলিশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধাদের ব্যানার কেড়ে নিয়েছে। তাদের প্রতি গুলি করিয়েছে। এদিকে এ ঘটনায় বিব্রত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও। এ বিষয়ে দলটির সভাপতিমন্ডলীর সদস্য পিযুষ কান্তি ভট্টচার্য বলেন, এগুলো খুবই দৃষ্টিকটু, শোভনীয় নয়। এ ধরণের অনৈক্য দূর করতে হবে। তা না হলে দলের ক্ষতি হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমি অফিসে এসে ঘটনাটি জানতে পেরেছি। পরে স্থানীয়ভাবে খোজখবর নিয়ে জানতে পারলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্চিত করার প্রতিবাদে স্থানীয় জনগণ তাদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশের অংশ হিসেবে ওই স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলে রেখে এসেছে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ বলেন, ১৮ নভেম্বর আওয়ামী লীগের নাগরিক সমাবেশ উপলক্ষে একটি প্রস্তুতি সভা ও সদস্য নবায়ন কার্যক্রম চলছিল। এ সময় কমিউনিটি সেন্টারের সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলে সভায় বাধার সৃষ্টি করা হয়। এটা করার মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগকে বাধা দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্চিত করার প্রতিবাদে এই ময়লা ফেলা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে-এমন বক্তব্যের জবাবে শাহে আলম মুরাদ অভিযোগ করে বলেন, এক নেতা বিশেষ ইন্ধনে কাউন্সিলর আবু আহমেদ মান্নাফি কিসের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নেমেছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, ফ্লাইওভার উদ্বোধনের সময় এবং গত ১ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে কাউন্সিলর মান্নাফি পুর্বপরিকল্পনা মোতাবেক গন্ডগোল সৃষ্টি করেছে। মান্নাফির গায়ে কেউ হাত তোলেনি। সিটি করপোরেশন অফিসে বসে নিজের গায়ের জামা ছিড়ে ফেলে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করিয়েছেন এবং এক সময়ের পিডিবে যোগদানকারী নেতার ষড়যন্ত্রের মিশন বাস্তবায়ন করছেন।

পাঠকের মতামত: