ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শহরবাসী

বিশেষ প্রতিবেদক :
পর্যটন শহর কক্সবাজার জুড়ে যততত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা আর্বজনা। জনসচেতনতার অভাব আর দায়িত্ববানদের অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনায় গোটা শহর যেন ময়লা-আবর্জনার বড় ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট, অলিগলি, নালা, নর্দমা, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা- সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। নর্দমার নোংরা ময়লা-পানি বইছে সড়ক দিয়ে। চারদিকের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকছে। প্রতিটি বাড়ির ফাঁকে, খোলা জায়গায়, গলিপথে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। যে কারণে পৌরবাসীকে এখন চলাফেরা করতে হয় নাক টিপে। নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনার উৎকট গন্ধ নাগরিক জীবনকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেললেও এর বিন্দুমাত্রও টের পান না কর্তৃপক্ষ। তবে কর্তৃপক্ষ মানতে নারাজ অব্যবস্থাপনার কথা। তাদের মতে বর্জ্য অপসারণে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় সঠিকভাবে শহরের বর্জ্য অপসারণ করা যাচ্ছে না।
কক্সবাজার পৌরসভায় প্রতিদিন গড়ে ১৬ ট্রাক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। পর্যটন এ শহরে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য অপসারণে হিমশিম খাচ্ছে পৌরসভা। অভিযোগের পর অভিযোগ, বর্জ্য অপসারণে পৌরসভার উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য দেখেছেন না সেবাগ্রহীতারা।
পৌরসভা সূত্র জানায়, শহরের ১২ টি ওয়ার্ড, সড়ক, উপসড়ক থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৬ ট্রাক ময়লা আর্বজনা বের হয়। পৌরসভা পরিষ্কার রাখার জন্য ১২০ জন নারী ঝাড়–দার কাজ করে। এছাড়া ১৪০ জন শ্রমিক কাজ করে যারা শহরের ময়লা আর্বজনা অপসারন করে ডাম্পিং ষ্টেশনে নিয়ে যায়। তবে এই শ্রমিকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক।
এ বিষয়ে কক্সবাজার পৌরসভার কনজারভেনটিভ সুপার ভাইজার দিলীপ রুদ্র বলেন, পৌরসভা পরিষ্কার রাখতে হলে কমপক্ষে ২০০ জন শ্রমিক দরকার কিন্তু এই মুহৃর্তে মাত্র ৮০ জন শ্রমিক রয়েছে। এছাড়া আমাদের গাড়ি, যন্ত্রপাতির অনেক সংকট রয়েছে।
কক্সবাজার পৌরসভার প্রশাসনিক কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বলেন, ময়লা অপসারণের জন্য আমাদের ৬ টি ট্রাক রয়েছে। এরমধ্যে ২ টি অকেজো। আর বাকি ৪ টি প্রায়ই সময় নষ্ট থাকে। একারণে আমাদের আরো ৪ টি ট্রাক দরকার। কক্সবাজার পৌরসভার জন্য ২৪ টি ঠেলাগাড়ি দরকার কিন্তু রয়েছে মাত্র ১৬ টি। এছাড়া টলি রয়েছে ১৬ টি অথচ দরকার ৩৬ টি।
কক্সবাজার পৌরসভার কানজারভেনটিভ সুপার ভাইজার কবির আহমদ বলেন, ময়লা আর্বজনা পরিষ্কারের জন্য সবচেয়ে বেশী দরকার পেলোডা মেশিনের। কিন্তু আমাদের একটি চাইনা পেলোডা মেশিন রয়েছে যেটি প্রায়ই সময় বিকল থাকে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে আরো দুটি পেলোডো মেশিন লাগবে।
তিনি আরো বলেন, পৌরসভার ডাম্পিং ষ্টেশন অনেকদূরে। সেকারণে ঠেলাগাড়ি দিয়ে প্রথমে অলিগলি থেকে আর্বজনা এনে এক জায়গায় স্তুপ করে ট্রাকে নিতে হয়। যদি কাছে একটি ডাম্পিং ষ্টেশন করা হয় তবে ময়লা পরিষ্কার করতে সুবিধা হবে।
শহরের ওর্য়াড ভিত্তিক ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট কোন স্থান না থাকায় এলাকাবাসী রাস্তায় ও নর্দমায় ময়লা করে। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘদিনের এই সমস্য থেকে পৌরবাসীকে রক্ষা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে পৌর কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিন দখা যায়, শহরের ব্যস্ততম এলাকা বাজারঘাটা, বার্মিজ মার্কেট, লালদিঘীর , গোলদিঘীর পাড়, হাসপাতাল সড়ক, বাহারছড়া, নতুন বাহারছড়া, কলাতলী রোড সহ পৌরসভা সব রাস্তা ও নর্দমা ময়লা আর্বজনায় ভরপুর হয়ে রয়েছে।
এতে আশপাশে তীব্র দুর্গন্ধে পথচারীদের যাতায়াতে সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে বার্মিজ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা খোরশেদা আরা বলেন, এই বিদ্যালয়ে প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। অথচ এই বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর ঘেষেই দিনের পর দিন পরে রয়েছে ময়লা আর্বজনার স্তুপ। নালা ভরে গেছে ময়লায়। বিশ্রী দুর্গšধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বাচ্চারা ক্লাস করছে।
নিউমার্কেটের দোকানদার আমিন বলেন, শহরের ব্যস্ততম এলাকা বাজারঘাটা। অথচ নাপিতের পুকুরপাড়ে এক সপ্তাহের অধিক সময় ধরে ময়লা আর্বজনা পড়ে আছে। দেখার কেউ নেই।
কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী যততত্র ময়লা আর্বজনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, যন্ত্রপাতি সংকট, লোকবলের অভাব পৌরবাসীর অসচেতনতাও এর জন্য দায়ী।
তিনি আরো বলেন, খুব শ্রীঘই পৌরসভার পক্ষ থেকে প্রতিটি এলাকায় মোবাইল ডাস্টবিন স্থাপন করা হবে। এছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়েরও চেষ্টা চলছে। একটি পেলোডো মেশিন কেনার জন্য আবেদন করা হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠন সেভ দ্যা ন্যাচার অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, শহরের অর্ধেক বর্জ্য অপসারন করে পৌরসভা। লোকবল সহ নানা স্বল্পতার কারণে বাকি অর্ধেক বর্জ্য অপসারণে অক্ষম তারা। আর এ ময়লাগুলো পরবর্তীতে সেই নির্দিষ্ট এলাকার পার্শ্ববর্তী ড্রেন ও নালা-নর্দমায় পড়ে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি করছে।
পরিবেশ সংগঠনগুলোর আরও অভিযোগ এই যে, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মেনে চলছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশ বর্জ্যই রাস্তার ওপর খোলা ডাস্টবিন, নর্দমা বা আশপাশের ডোবা-নদীতে ফেলা হচ্ছে। আর চিকিৎসা বর্জ্যগুলোর মধ্যে আছে রোগীর ব্যবহৃত সুই, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, ওষুধের ব্যবহৃত শিশি, ব্যবহৃত স্যালাইনের প্যাকেট, টিউমার, রক্তের ব্যাগ, রাসায়নিক দ্রব্যসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসাজাত ময়লা-আবর্জনা।
কক্সবাজারের পরিবেশবীদ বিশ্বজিৎ সেন বাঞ্চু বলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ফলে পুরো শহরই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, গৃহস্থালি বর্জ্যের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল বর্জ্যও একই সঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এগুলো সাধারণ ময়লার সঙ্গে মিশে সংক্রামক ও ক্ষতিকর বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ছে হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়ার মতো রোগ।

পাঠকের মতামত: