ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বড়বিলের শাপলা এলাকাবাসীর জীবিকা

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::

চকরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বরইতলী-পেকুয়া-মগনামা সড়ক লাগোয়া হারবাং ইউনিয়নের বিশাল এলাকা নিয়ে বড়বিলের অবস্থান।

প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমসহ প্রায় আটমাস ধরে জলাবদ্ধতায় টইটম্বুর থাকে এক হাজার ২০০ হেক্টর বিশিষ্ট কক্সবাজারের চকরিয়ার ঐতিহ্যবাহী হারবাং বড়বিল। এতে জমির মালিকেরা আর্থিকভাবে টানাপড়েনে থাকেন।

ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় রূপ নেওয়ায় বছরের দুই মৌসুমে ধান এবং সবজি ফলানো থেকে বঞ্চিত হন কয়েক শ কৃষক। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপরিকল্পিত হওয়ায় এবং বড়বিল সংলগ্ন ছড়াখাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিপুল পরিমাণ এই কৃষিজমির সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না এসব হতভাগ্য কৃষক।অবশ্য এই হতাশার মাঝেও আছে আশা জাগানিয়া খবরও। প্রতিবছর অন্তত আটমাস পর্যন্ত এই বড়বিল যখন ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় টইটম্বুর থাকে, তখন সেখানে কাউকে জাল ফেলে মাছ ধরতে এবং আবার কাউকে বিলের শাপলা তুলে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা যায়। ঐতিহ্যবাহী এই বড়বিল থেকে শুধু শাপলা তুলে সংস্থান হচ্ছে অন্তত ৫০ পরিবারের জীবিকা। প্রতিবছরের আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই বিল থেকে শাপলা পাওয়া যায়। অবশ্য এর পর শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে সেখানে কৃষকেরা নামেন রকমারি সবজি, তরমুজ, বাঙি ও ধানচাষে।

বড়বিলের কাছের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বছরের সাত-আটমাস ধরে তারা হারবাং বড়বিলের ওপরই নির্ভরশীল। কেউ শাপলা বিক্রি এবং কেউবা মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে পরিবারের ভরণ-পোষণ মেটাচ্ছেন।

এভাবে অন্তত ৫০ পরিবার শাপলা তুলে এবং আরো প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার বড়বিলের মাছ ধরে আসছেন।চকরিয়া সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বরইতলী-পেকুয়া-মগনামা আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের বিশাল এলাকা নিয়ে এই বড়বিলের অবস্থান। এই বড়বিলের ওপর দিয়েই চলমান আঞ্চলিক মহাসড়ক। আর এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করার সময় চোখে পড়বে বড়বিল। দিগন্তজোড়া সেই বড়বিলে ফুটে রয়েছে হরেক রকমের শাপলা। যা স্বচক্ষে দেখলেই মন জুড়িয়ে যাবে।

স্থানীয়রা জানান, হারবাং ইউনিয়নের বড়বিলের দক্ষিণাংশে রয়েছে বরইতলী ইউনিয়ন। বরইতলীর মছনিয়াকাটাও এই বড়বিলের কিছুটা দখলে রেখেছে। এই বড়বিলের আয়তন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নেই তাদের কাছে।

তবে উপজেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমি নিয়ে এই বড়বিল প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠেছে। পুরো বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও হারবাং ছড়ার পানিতে বড়বিলটি অন্তত আটমাস ধরে জলাবদ্ধতায় টইটম্বুর থাকে। বছরের অধিকাংশ সময় এই বড়বিল জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকায় সেখানে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙের শাপলা ফুটে সৌরভ ছড়ায়। ছোট নৌকায় চেপে পুরো বিল ঘুরে দেখলে দেখা মেলবে হরেক প্রজাতির শাপলা ফুটে হাসছে। এর মধ্যে সাদা শাপলা ফুল সবজি হিসেবে বেশ জনপ্রিয় এবং অত্যধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। তাই সাদা শাপলা বিক্রি করে অন্তত অর্ধ শতাধিক পরিবার গত দশবছর ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। যা অত্যন্ত খুশির খবর।

সরেজমিন দেখা গেছে, হারবাং ইউনিয়নের পুরো এই বড় বিলের ৮০ শতাংশ জমি ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় তলিয়ে রয়েছে। সেখানে দুরন্তপনা শিশু, কিশোর-কিশোরীরা বিলে মাছ ধরছে। আবার বয়োজ্যেষ্ঠরা আগাছা পরিষ্কারের অংশ হিসেবে অনেকেই বিল থেকে শাপলা তুলে নৌকায় তুলে সড়কের ধারে এনে স্তূপ করছেন।

ঐতিহ্যবাহী হারবাং বড়বিলে কখন থেকে শাপলা ফুটছে তার নির্দিষ্ট সময় কেউ সঠিক করে বলতে না পারলেও কয়েকজন কৃষক জানান, তাদের জন্মের পর থেকে এই বিলে শাপলা দেখে আসছেন। বড়বিল থেকে শাপলা তুলে তা স্থানীয় বাজার ছাড়াও কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সরবরাহ করছেন। বিনিময়ে অনেকে প্রতিদিন গড়ে ৭শ থেকে ৮শ টাকা আয় করছেন। এই আয় দিয়ে ভালোভাবেই চলছে তাদের সংসার। হারবাং বড়বিল থেকে প্রতিদিন শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহকারী দুজন কৃষকের সাথে কথা হয় সম্প্রতি। তাঁদেরই একজন হারবাং এর ডবলতলী গ্রামের শাহাব উদ্দিন ও অপরজন শাহ আলম। তাঁরা বলেন, ‘গরমের সময় সারাদিন কাঠফাটা রোদ বা  বর্ষা মৌসুমে মুষলধারে বৃষ্টি হলেও প্রতিদিন তারা এই বড়বিলে আসেন শাপলা তুলতে।

আমাদের মতো আরো অন্তত অর্ধ শতাধিক পরিবার এই বড়বিলের শাপলার ওপরই নির্ভরশীল। প্রতিদিন শাপলা তুলে তা বিক্রি করে আয় করছি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।

তাঁরা জানান, প্রতিবছর ৭-৮ মাস পর্যন্ত এই বড়বিলের বিশালায়তনের কৃষিজমি ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকে। একে কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার সীমা থাকে না। তাই গত দশবছর ধরে এই বিল থেকে নিয়মিত শাপলা তুলে স্থানীয় এবং চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। আর বিপরীতে ভালো আয় হচ্ছে তাদের।

কৃষক শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে বিলে নেমে বিকেল পর্যন্ত তোলা হয় প্রায় ৪শ তোড়া (একগাদা) শাপলা। আর প্রতি তোড়াতে থাকে ৪০টি শাপলা। এই এক তোড়া শাপলা বিক্রি করে পাওয়া যায় ২০ টাকার মতো। ’

কৃষকেরা জানান, ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে কনকনে শীত যখন পড়তে শুরু করে তখন বিলের পানি একটু কমে আসতে থাকে। তখন বিলের শাপলাও মরে ওঠে।

হারবাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম মিরান জানান, হারবাংবাসীর জন্য জনমদুঃখ হয়ে পড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বড়বিল। বড়বিলের পানি চলাচলের হারবাং ছড়াখালটি বড়বিল অংশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভরাট হয়ে থাকায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে বছরের সিংহভাগ সময় কোনো ফসল ফলানো যাচ্ছে না। কয়েকযুগ ধরে এই অবস্থা অব্যাহত থাকায় এখানকার কৃষকেরা প্রতিবছর আর্থিকভাবে মার খাচ্ছে তাদের জমির সঠিক ব্যবহার করতে না পারায়।

তিনি অভিযোগ করেন, কয়েকবছর আগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে অপরিকল্পিতভাবে দুটি খাল খনন করে সরকারের টাকার জলাঞ্জলি দেয়। এতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পায়নি এই বড়বিল। এই অবস্থায় আমন ও বোরো মৌসুমে চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না বিলটি। যদি চাষাবাদের আওতায় আনা সম্ভব হতো তাহলে প্রতিবছর শুধুমাত্র আট হাজার ৬শ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করা যেত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বড়বিল নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। যেখানে সরকারের নীতি হচ্ছে এক ইঞ্চি কৃষিজমিও ফসল ফলানো ছাড়া খালি রাখা যাবে না।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ জানান, শাপলা আসলে কোনো কৃষি পণ্যের আওতায় পড়ে না। শাপলা প্রাকৃতিকভাবে জন্মায় পরিষ্কার পানির কৃষি জমি, পুকুর বা ডোবাতে।

কৃষিবিদ আতিক উল্লাহ বলেন, ‘শাপলা তিন প্রজাতির হয়ে থাকে। তন্মধ্যে সাদা, লাল ও বেগুনি রঙয়ের। সাদা প্রজাতির শাপলা ফুল সবজি হিসেবে ও লাল রঙের শাপলা ব্যবহার হয় ঔষধি কাজে। শাপলা খুবই পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সবজিও। সাধারণত শাক-সবজির চেয়েও এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। তাই বাজারে এই শাপলার কদরও রয়েছে বেশ।

সেই শাপলা বিক্রি করে এখানকার অন্তত ৫০ পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। ’

ভয়াবহ জলাবদ্ধতা থেকে বড়বিলকে রক্ষা করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, এই বড়বিলের বিপুল পরিমাণ কৃষিজমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে। ’

পাঠকের মতামত: