ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

উখিয়া ও টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনিবন্ধিত এনজিওর অপতৎপরতা

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি, ৩০ অক্টোবর ॥

কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিতা রোহিঙ্গাদের সেবার নামে কর্মরত কতিপয় অনিবন্ধিত এনজিও কর্মীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীকরণের ষড়যন্ত্র এবং এদের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জঙ্গীবাদ উৎপত্তি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। একাধিক এনজিও সরকারের এনজিও ব্যুরো কিংবা স্থানীয় প্রশাসন থেকে অনুমোদন না নিয়ে টেকনাফ-উখিয়া এলাকায় তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে ঘোর অভিযোগ উঠেছে। এদের গতিবিধি ও কর্মকান্ড সন্দেহজনক বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সমুদ্র ঘেঁষা দুর্গম এলাকা টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে সরকারের অনুমোদনবিহীন রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপন, স্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ ও তাদের খাবারের ব্যবস্থার দায়িত্ব পালনকারী এনজিও মুআাসের বিরুদ্ধে নিয়মবহির্ভূত বহু কর্মকান্ড চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ওই এনজিওতে হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামী, একাধিক কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও সাবেক শিবির ক্যাডারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় খুনসহ একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, এনজিও মুআসের স্টিকার লাগানো একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি রাত ১২টার পর সমুদ্র এলাকায় ও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাফেরা করার বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখছেন স্থানীয়রা। ওই এনজিও কর্মীদের কিছু কিছু কর্মকান্ডে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা উশৃঙ্খল হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সচেতন মহল। কয়েক কর্মকর্তা রাতে নির্জন স্থান শামলাপুর সমুদ্রের বালিয়াড়িতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গোপনে বৈঠকেও বসেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসবের পেছনে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা তদন্তের দাবি উঠেছে সর্বমহল থেকে। ওই এনজিওতে নিয়োগকৃত পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে,উখিয়ার মনখালীর জমির, ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ নূর হত্যা মামলার আসামিসহ শিবিরের চিহ্নিত একাধিক ক্যাডার। রয়েছে মনগড়া নিয়োগকৃত অস্ত্রধারী ব্যক্তিগত সিকিরিউটি। তাদের নিয়োগের আগে এনজিও কর্মকর্তারা পুলিশি রিপোর্টও নেননি বলে জানা গেছে।

অভিজ্ঞজনরা বলেন, সমুদ্র ঘেঁষা ও জঙ্গী তৈরির উর্বর হওয়ায় শামলাপুর এলাকাটি ইয়াবা, মানবপাচার ও অস্ত্র আনা-নেওয়ার চিহ্নিত পয়েন্ট বলে মশহুর রয়েছে। বিপজ্জনক ও ক্রাইম জোন হিসেবেও শামলাপুর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত এটি। গত বছরের ৩০ জুলাই পুলিশ-বিজিবি যৌথ অভিযান চালিয়ে শামলাপুরে গোপন বৈঠকস্থল থেকে গ্রেফতার করেছিল ৪ আরএসও জঙ্গীকে। অরক্ষিত সমুদ্রপথে ট্রলারযোগে অস্ত্র, ইয়াবা ও মানবপাচার হয়ে থাকে এই পয়েন্ট দিয়ে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নির্জন স্থানে গোপন বৈঠক, তাদের খাবার ও চিকিৎসাকল্পে হাসপাতাল স্থাপনকে কেন্দ্র করে জেলা জুড়ে চলছে বিভিন্ন কানাঘুষা।

তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গার সমস্যা সমাধান করতে যেখানে সরকার কূটনৈতিক পর্যায়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে বিদেশী এনজিও, জামায়াত নেতা ও দেশে ঘাপটি মেরে থাকা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী আরএসও, আরসা, আলেকিন ক্যাডারদের নানা ষড়যন্ত্র কখনও মেনে নেওয়া যায় না।

এদিকে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে জঙ্গীবাদ উৎপত্তি হওয়ার আশঙ্কা করেছেন খোদ টেকনাফ কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নেতৃবৃন্দ। সূত্রে জানা যায়, ওই এনজিওটি বাংলাদেশে এসে প্রথমে ১১ সেপ্টেমর শামলাপুর ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করে। পরবর্তীতে শামলাপুরে মেডিকেল টিম গঠন করার নামে কক্সবাজার সিভিল সার্জনের অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে অন্যব্যক্তির খতিয়ানভুক্ত জমির ওপর হাসপাতাল স্থাপন করে ফেলে। এমনকি সেখানে তৈরি করা হয় রোহিঙ্গা ক্যাম্পও। বিষয়টি জানতে পেরে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন মুআসের কর্মকর্তাদের ডেকে এনে সরকারী নিয়ম মতে এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন নিতে পরামর্শ দেন। চিকিৎসা কার্যক্রম তথা হাসপাতাল স্থাপনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের অনুমতি নিতে পরামর্শ দেন সিভিল সার্জন ডাঃ আবদুচ্ছালাম।

এদিকে, ওই এনজিওটির পক্ষে ঢাকায় অবস্থানকারী কেন্দ্রীয় জামায়াতের বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এক শীর্ষ নেতা তদবির চালিয়ে গেলেও মুআস এ পর্যন্ত এনজিও ব্যুরোর নিবন্ধন নিতে পারেনি। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত রিপোর্টে বহুবিধ নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রমের অভিযোগ এবং তাদের কাগজপত্রাদি সঠিক না হওয়ায় এনজিও ব্যুরো মুআসকে অনুমোদন দেয়নি বলে জানা গেছে। তারপরও তারা শামলাপুর এলাকায় দেশী-বিদেশী ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম ও ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, কক্সবাজারের সিভিল সার্জনকে কৌশলে বশে এনে এনজিও মুয়াসের কর্মকর্তারা তাদের অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে রবিবার থেকে টেকনাফের উনচিপ্রাং এলাকায় আরও একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে চলছে। অথচ বিদেশী ডাক্তারের মাধ্যমে কোথাও চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হলে বিএমডিসির অনুমোদনের নিয়ম রয়েছে।

সূত্র জানায়, একাধিক বিদেশী এনজিও সংস্থা টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের সেবার নামে এনজিও ব্যুরোকে কোন ধরনের অবহিতকরণ না করে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নিবন্ধনের জন্য একেকটি আবেদন করেই চুপচাপ বসে আছেন তারা। নিয়ম মতে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদন নিলে ওই এনজিও’র নামে বিদেশ থেকে আসা ফান্ড এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে খালাস করে নিতে হয়। প্রতি সপ্তাহে হিসাব দিতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। তাদের কর্মকান্ড এনজিও ব্যুরোর এখতিয়ারভুক্ত হয়ে পড়ে। জবাবদিহিতার আওতায় চলে আসে নিবন্ধিত এনজিওগুলো। এতে ওসব এনজিওর কতিপয় প্রতিনিধি দু’হাতে টাকা কামাই করতে পারেন না। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত মুআসসহ একাধিক এনজিও সরকারকে অবহিতকরণ ছাড়াই বিদেশী ফান্ড তসরুপ করে চলছে। খরচ করছে তাদের ইচ্ছামতো। রোহিঙ্গা-স্থানীয়দের নামে বিদেশ থেকে মোটা অঙ্কের ফান্ড এনে ব্যয় করা হচ্ছে ফাইভস্টার হোটেলসহ বিমানে আসা-যাওয়ার কাজে। ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে কতিপয় এনজিও কর্মকর্তা থাকছেন মাসের পর মাস।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম মতে নিবন্ধনকৃত এনজিওর নিয়োগকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন প্রদান করতে হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু কতিপয় এনজিও কর্মকর্তা নিয়োগকৃত তাদের স্টাফদের নামে এক থেকে দেড় হাজার ডলার সমপরিমাণ বেতনের স্বাক্ষর নিলেও তাকে দেয়া হচ্ছে ২০-২৫ হাজার টাকা। স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত না করে বহু কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে ওই এনজিও কর্মীরা। কতিপয় এনজিও প্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের তাড়াতাড়ি স্বদেশে ফিরে না যেতে ইন্ধন দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ওসব এনজিওর কর্মতৎপরতার ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে বলে জানাগেছে। নিবন্ধনবিহীন এনজিও মুআস কক্সবাজারের ইসলামী ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ টাকা আনছে বলে তথ্য মিলেছে। একজন আমেরিকা ও অপরজন ইটালিয়ান এনজিও কর্মকর্তা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে কক্সবাজারে এসে গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে উখিয়ার ইনানীর একটি পাঁচ তারকা মানের হোটেলে দিনযাপন করছেন। ডাক্তার-নার্সদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে সমুদ্র সংলগ্ন উখিয়ার সোনারপাড়ায় একটি রিসোর্ট। রাতে মুআসের গাড়ি নিয়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কে ও সাগরপাড়ে ঘোরাফেরা করেন কতিপয় জনপ্রতিনিধি।

বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে সেখানে কোন ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে সরকারের দুর্নাম হতে পারে জানিয়ে স্থানীয়রা বলেন, এনজিওটি একদিকে অনুমোদনহীন, অপরদিকে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের সমুদ্র সংলগ্ন স্থানে স্থাপনা গড়ে তোলা ও বাসা ভাড়া নেয়া উচিত হয়নি।

পাঠকের মতামত: