ঢাকা,শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

খালেদার গাড়িবহরে হামলা ফেনীতে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর, সাংবাদিক আহত চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মারধর

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে যাওয়ার পথে ফেনী শহরের আশপাশে বিভিন্ন স্থানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। ফেনী শহরের কাছে ফতেপুর রেলক্রসিং অতিক্রম করার পরপরই বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে প্রথম হামলাটি হয়।
এ সময় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন দুর্বৃত্ত লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়িবহরে হামলা চালায়। এ ঘটনায় ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।

এ সময় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের সঙ্গে থাকা বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই, ডিবিসি, একাত্তর ও বৈশাখী টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন ও নিউএজ পত্রিকার সাংবাদিকসহ আটজন সাংবাদিককে বহনকারী একটি গাড়ি ও বেশ কিছু যানবাহনে ভাঙচুর চালানো হয়। ফেনী রেলক্রসিংয়ের কাছে ঢাকা থেকে আসা তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের নেতাদের বহনকারী একটি গাড়িতে প্রথমে ভাঙ্চুর ও পরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। একই সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের বহরে থাকা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ও নেতা-কর্মীকেও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী জানান। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এ হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আহতদের প্রতি সহমর্মিতা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হামলার ঘটনাকে বর্বরোচিত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সরকারি পেটোয়া বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এ হামলা চালিয়েছে। তিনি অবিলম্বে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তবে এ হামলার পরও বিকাল ৫টা নাগাদ নিরাপদে ফেনী সার্কিট হাউসে পৌঁছান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটের দিকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে তিনি রওনা হন।

সন্ধ্যার আগে ফেনীর মহীপালসহ একাধিক স্থানে হামলার পর রাতে সার্কিট হাউস থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ফের মিরসরাইয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। এ সময় বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভির গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এ হামলা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, হামলাকারীদের লাঠি ও ঢিলের আঘাতে একটি গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। এ সময় কয়েকজন আহত হন। এর আগে মহীপালে হামলার ঘটনার পর ফেনী সার্কিট হাউসে খাবার গ্রহণ ও নামাজ আদায় করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সেখান থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলে মিরসরাইয়ের নিমচরে গাড়িবহরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এর আগে চার দিনের কক্সবাজার সফরের উদ্দেশে গতকাল সকালে ঢাকার গুলশানের বাসা থেকে রওনা হন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি-প্রধানকে এক নজর দেখার জন্য নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড় জমে। ঢাকার নয়াপল্টন, কাঁচপুর, মোগড়া, মদনপুর, নিমসার বাজার, গজারিযা, কুমিল্লার মুরাদনগর, দাউদকান্দি, ক্যান্টনমেন্ট এলাকা, পাদুয়ার বাজার, দয়াপুর, মিয়াবাজার, গার্লস স্কুল রোড, চৌদ্দগ্রাম, চণ্ডীপুর ও ফেনীর মো. আলী বাজার, ফেনী সার্কিট হাউস ও চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার দুই পাশে ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড হাতে ফুল নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। বেগম খালেদা জিয়া দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের জবাবে গাড়ির ভেতর থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানান। দলের স্থায়ী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা দুই শতাধিক গাড়ি নিয়ে এ বহরের সঙ্গে যুক্ত হন।

পথে গতকাল রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে যাত্রাবিরতি করেন তিনি। আজ সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে কক্সবাজরের উদ্দেশে রওনা হবেন বেগম খালেদা জিয়া।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাড়িবহর ফেনীর ফতেপুর রেলক্রসিং অতিক্রম করার পরপরই অতর্কিতে হামলা চালানো হয়। এ সময় বিএনপির দলীয় পোস্টার ও স্টিকার লাগানো বেশ কিছু গাড়ির কাচ ভেঙে ফেলা হয়। আওয়ামী লীগের স্থানীয় মেয়র হাজি আলাউদ্দিনের মালিকানাধীন স্টার লাইন পেট্রলপাম্পের কাছ থেকে গাড়িবহরে হামলা করা শুরু করা হয়। দুর্বৃত্তরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে এ হামলা চালায়। তাদের অনেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায়। পরে মহীপাল ও বারইয়ার হাট নামক স্থানে গাড়িবহরের সঙ্গে থাকা সাংবাদিকদের গাড়িতেও হামলা চালানো হয়। হামলার শিকার একাত্তর টিভির সাংবাদিক শফিক আহমেদ বলেন, অতর্কিতে ৪০ থেকে ৫০ জন যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে গাড়ির ওপর হামলা চালায়। তাকে ও তার চিত্রগ্রাহক আলম হোসেনকে তারা মারধর করে। চ্যানেলের ক্যামেরাও ভেঙে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার পর থেকেই মূলত এ হামলা শুরু হয় এবং রাত ৮টার পরও রাস্তায় হামলাকারী দুর্বৃত্তরা অবস্থান করে। এর আগে বেলা ১টার দিকে কুমিল্লায় খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য আসা বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় কর্মীরা। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রোহিঙ্গাদের দেখতে কক্সবাজার যাওয়ার পথে কয়েক জায়গায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে বলে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। রিজভী বলেন, বিএনপির জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল এ হামলা করেছে। বিএনপি নেত্রীকে দেখতে পথে মানুষের যে ঢল নামে, সেই ঢল থামাতেই সরকার-সমর্থকেরা এই ‘নিম্ন রুচি’র পরিচয় দিয়েছেন। এসব হামলা ও বাধা দিয়ে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমানো যাবে না। বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবে রহমান শামীম জানান, ভাঙচুরের শিকার গাড়ির সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যাবে। এ ঘটনায় আহত বেশ কয়েকজনকে রাতে ফেনীর দুটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অন্যদের চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হয়েছে।

কুমিল্লায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলুর গাড়িবহরে হামলা হয়। ফেনীতে হামলার পর পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খালেদা জিয়া ফেনী সার্কিট হাউস থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে খালেদা জিয়ার গাড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পর ফেনী শহরের চার কিলোমিটার আগে মোহাম্মদ আলীবাজারে একদল যুবক হামলা চালায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গণমাধ্যমের আটটি গাড়িসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের শতাধিক গাড়ি। বেসরকারি টেলিভিশন এনটিভি, একাত্তর, ডিবিসি, চ্যানেল আই ও বৈশাখী টেলিভিশন, একুশে টিভি, যমুনা, এটিএন নিউজের গাড়ি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের একটি মাইক্রোবাসও হামলামুখে পড়ে। এনটিভির সিনিয়র রিপোর্টার হাসান মাহমুদ, একাত্তর টিভির আলোকচিত্রী আলম হোসেন ও সিনিয়র প্রতিবেদক শফিক আহমেদ গুরুতর আহত হয়েছেন। বৈশাখী টিভির সিনিয়র রিপোর্টার গোলাম মোর্শেদ, কালের কণ্ঠ, নয়া দিগন্ত, যুগান্তর, যায়যায়দিন, সংগ্রাম, জিটিভি, আমাদের সময়সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা হামলার শিকার হন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী মারধরের শিকার হন। একাত্তর টিভির এক কর্মী ভিডিও ধারণ করতে গেলে তিনিও মারধরের শিকার হন। ঢাকা মহানগর বিএনপি দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার জানান, তাদের বহরে থাকা মহানগর দক্ষিণের ১০-১১টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। হামলাকারীরা বহরে আসা গাড়িগুলো বেছে বেছে ভাঙচুর করতে দেখা গেছে। মোহাম্মদ আলী বাজারের কাছে বহরের বাইরে দূরপাল্লার বাসসহ ট্রাক ও প্রাইভেট কারগুলো ভাঙচুর করেনি। হামলাকারীদের হাতে অস্ত্রও দেখা গেছে।

খালেদা জিয়ার বহর দাউদকান্দি অতিক্রমের আগে দুপুরের দিকে দাউদকান্দিতে বিএনপির কয়েকটি গাড়ি ছাত্রলীগের সশস্ত্র যুবকরা ভাঙচুর করেছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু। এ সময় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ও খন্দকার মাশুকুর রহমান বুলু সঙ্গে ছিলেন। এ ছাড়া, মুন্সীগঞ্জের ভবেরচর ও কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জের কাছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা দুপুরে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালায় বলে স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। ফেনীতে যাত্রাবিরতির সময় খালেদা জিয়ার সঙ্গে নেতা-কর্মীদের সাক্ষাৎ ঠেকাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সড়কে অবরোধ করে বলে স্থানীয় বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন। বেগম জিয়া ফেনী যাওয়ার সময় পথে পথে বিভিন্ন জায়গায় সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থী নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে শোডাউন করে। কুমিল্লার মুরাদনগরের সাবেক এমপি শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক ইলিয়টগঞ্জে খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানান। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের ঢল নামে। ফলে ওইসব স্থানে ব্যাপক যানজটেরও সৃষ্টি হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর কাঁচপুর ব্রিজের আগেই ব্যাপক যানজটের মুখে পড়ে। ঘণ্টা খানেক তার গাড়ি বসেছিল। এ সময়ে তার নিরাপত্তা কর্মীরা গাড়িটি ঘিরে রাখে।

খালেদার সফরে পুলিশের বাধা নেই : রোহিঙ্গাদের দেখতে যাওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার কর্মসূচিতে সহযোগিতা করতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খালেদার কর্মসূচিতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (জনসংযোগ) আকরামুল হোসেন বলেন, বেগম জিয়ার সার্কিট হাউসে রাত যাপন উপলক্ষে আশপাশের এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সিএমপি জানায়, মহাসড়ক বন্ধ করে জনসভা কিংবা পথসভা করতে দেবে না।

খালেদার সফরসঙ্গীদের জন্য মেজবান : খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গীদের জন্য চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন মেজবানির আয়োজন করেছেন। দুই হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন ছিল সেখানে।

পাঠকের মতামত: