ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ফেসবুক সাংবাদিকতা মুড়ির চেয়ে সস্তা!

সেলিম উদ্দীন ::

প্রযুক্তির কল্যাণে গনমাধ্যমে যুক্ত হয়েছে অনলাইন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজ। যা খুশি নামের ডটকম বসিয়ে কেউ কেউ হয়ে উঠছেন সাংবাদিক! খুব সহজ হকার হিসাবে ব্যবহার করছেন ফেসবুককে। তবে বিপত্তি অন্য জয়গায় গজিয়ে উঠা এসব ডটকমের সাংবাদিকদের নুন্যতম যোগ্যতা না থাকলেও দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন এলাকায়। পঁচা আদার নাকি ঝাঁজ বেশী। তারা আর কিছু পারুক আর না পারুক ইনিয়ে বিনিয়ে বেশ রং লাগিয়ে ধর্ষন, পরকিয়া, অসম প্রেম জাতীয় চটকদার ও রসালো খবর বানাতে পারে বৈকি!

ভালমত খোঁজ খবর না নিয়ে শুধুমাত্র মোবাইলে কিংবা অন্যের লিখা হুবুহু কপি করে নজরকাড়া শিরোনাম ও ভয়ানক কাল্পনিক ছবি ব্যবহারের মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ করছেন। হাবিজাবি খবরগুলোকে খাবার বানানো এরকম হিট সাংবাদিক ছড়িয়ে গেছে সমস্ত গ্রামের পাড়ায়-পাড়ায়। অল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি, যে খবর মানুষ বেশী পড়বে বলে মনে হয় তা প্রকাশ করা তথ্য ব্যবসা, কিন্তু খবর প্রকাশের পর কি ধরনের প্রভাব সমাজের উপর পড়বে সেটি ভেবে সংবাদ প্রকাশই হল প্রকৃত সাংবাদিকতা। তাই জনস্বার্থের কথা চিন্তা না করে, রসালো মনগড়া ও চমক সৃষ্টিকারী খবর প্রকাশ সাংবাদিকতা নয় বরং ক্যাম্পাচারী।

কিছু ফেসবুক পেইজ আছে যেগুলো ন্যাংটা হয়ে দলবাজি, জনৈক ব্যক্তির পদলেহন-এজেন্ডা বাস্তবায়ন, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের চামচামি করছে। রাত দিন খাসিকে পাঁঠা, গাধাকে হাতি বানাচ্ছে। আমি হলফ করে বলতে পারি এ সকল তোষামোদ মার্কা সাংবাদিকতা কেবল অপসাংবাদিকতার নামান্তর।

বাজিরে..! প্রযুক্তির কল্যানে গ্রামের দিনমজুর পর্যন্ত এখন সচেতন। এখন আমজনতাই সাংবাদিক, তাদের আছে বড় সংবাদ মাধ্যম যার নাম ফেসবুক। আমি জানি, লিখার শিরোনামটি দেখে অনেকে মারমুখী। কিন্তু বর্তমান সময়ে কতিপয় বহু ক্রিয়াশীল সাংবাদিকদের খবর লিখার ধরন ও কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে এর থেকে যুতসয় কোন ক্যাপশন খুঁজে পাইনি।

তবে বিষয়টি সম্পুন্ন ভিন্ন। কারন প্রযুক্তির কল্যাণে আজ যে যতবড় প্রযুক্তিবিদ সে ততবড় সাংবাদিক। অনেকে নিজেকে জাহির করার জন্য ফেইসবুক পেইজ সাংবাদিকতা করছে। যা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতা নয়। তবে সঠিক সাংবাদিকতা করেন শুধুমাত্র গুটি ক’জন সাংবাদিক। এ ও জানি তাঁদের অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। বাকীরা কপি সাংবাদিকতায় ব্যস্ত। নাম সর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন পত্রিকার আইডি কার্ড অথবা অনলাইন পোর্টালের মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তারা চষে বেড়াচ্ছেন। অর্ধ-শিক্ষিত সুবিধাবাদী এই সমস্ত সাংবাদিকরা প্রকৃত সাংবাদিকদের বির্বতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলছেন। তাই ঐ সকল সাংবাদিকদের বলছি আপনারা কপি-পেষ্টের সাংবাদিকতা ছেড়ে সৃজনশীল ও প্রকৃত সাংবাদিকতার চর্চা করুন। দিনশেষে সাংবাদিকতা একটি আবেগের স্থান, দায়িত্ববোধ ও সম্মানের স্থান। তাই প্রকৃত সাংবাদিক ভাইদের বলছি আপনারা এমনি এমনি সাংবাদিকদের বয়কট করুন। নতুবা আপনারাও পাবলিকের নিকট হাস্যস্পদে পরিণত হবেন।

এবার আসি মূল কথায়, সাংবাদিকরা এখন আর শুধু একক মাধ্যমে কাজ করেন না। ফলে সময়ের সংগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মী। এখন কম বেশী সবারই নজর থাকে সাংবাদিক হওয়ার দিকে। সেটি সংবাদপত্র, রেডিও, অনলাইন পত্রিকা হোকনা ফেইসবুক পেইজ ।

আচ্ছা মন চাইলেই কি সাংবাদিক হওয়া যায়? বাজারের চাল ডালের মত টাকার বিনিময়ে এখন প্রেস কার্ড নাকি কিনতে পাওয়া যায়। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বালাই নেই। সম্পাদকের সংগে যদি ভাল সম্পর্ক থাকে অথবা দু-চারটে বিজ্ঞাপন দিলে তো আর কথায় নেই, প্রেস কার্ড প্রাপ্তি নিশ্চিত !

সত্যি বলতে কি, আচমকা গজায়া উঠা এই সমস্ত এমনি-এমনি সাংবাদিকদের দাপটে কোনঠাসা প্রকৃত সাংবাদিকরা। যথার্থ শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব, প্রশিক্ষণ, লোভ, পেশাদারিত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বাড়ছে দালাল, গলাবাজ ও অপ-সাংবাদিকতা। আসলে গণমাধ্যমের বর্তমান এই বেহাল দশার জন্যে কারা দায়ী? যাঁরা গণমাধ্যমে কাজ করেন তারা, নাকি যারা অযোগ্য ব্যাক্তিদের এই মাধ্যমে কাজ করার সুযোগ করে দেন তারা।

নেশা হউক আর পেশা হউক যদি কেউ সাংবাদিক হতে চান তবে তাকে অবশ্যই পুরোদস্তর সাংবাদিক হতে হবে। সাংবাদিকতা কখনো জাতে উঠার মই হতে পারেনা। তাই যারা সিগারেট খান না শুধুমাত্র কোম্পানীর প্রচারের জন্যে দু-একটা সুখটান দেন অর্থাৎ টুকটাক সাংবাদিকতা করেন তাদেরও মনে প্রাণে সাংবাদিক হতে হবে। হতে হবে সৎ। সাংবাদিকতাকে কোনভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবেনা। মনে রাখতে হবে সাধারন মানুষ এখনো সাংবাদিকদের সম্মানের চোখে দেখে শ্রদ্ধা করে।

সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে একজন সংবাদকর্মীর মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রেস ফ্রীডম মানেই স্বেচ্ছাচারিতা নয়, তথ্য বিকৃতি নয়। তিলকে তাল বানানো অথবা তালকে অদৃশ্য করা যাবে না। একজন প্রকৃত সাংবাদিক যা মন চায় তা তিনি লিখতে পারেন না, কারণ তিনি আইন ও বিবেকের উর্ধ্বে নয়। পাশাপাশি, শহরের সাংবাদিকতা আর মফস্বল সাংবাদিকতা দুটি ভিন্ন জিনিস ও ভিন্ন ঝুঁকি। উচিত কথা বলার কারণে মফস্বল সংবাদকর্মীরা অনেকের বিরাগভাজন হন।

তবুও দিনশেষে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যা ছাড়া সমাজ ও গণতন্ত্র পূর্ণতা পাইনা। আশা রাখি নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করুক সব সংবাদকর্মী, আস্থা অর্জন করুক সব গণমাধ্যম।

ইদানিং লোকমুখে শুনা যায় হলুদ সাংবাদিকতা। বর্তমানে গণমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই হলুদ সাংবাদিকতা। জোসেফ পুলিৎজারকে বলা হয় গ্রান্ডফাদার অব দ্যা জার্নালিষ্ট অর্থাৎ সাংবাদিকতার পিতামহ। যাঁর নামের উপর সাংবাদিকতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার (পুলিৎজার) দেয়া হয়। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সেই ব্যাক্তিই কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার জনক। কিতাবি ভাষায় হলুদ সাংবাদিকতাই সত্যের সাথে মিথ্যার মিশ্র থাকে। যেখানে সাধারন ঘটনাকে রং চঙ মেখে সাংঘাতিক ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। তাই আজকাল কেউ কেউ সাংবাদিকদের সাংঘাতিক বলে মশকারা করেন।

আচ্ছা সাংবাদিকতায় আবার রং কিসের? সাংবাদিকতা হবে টিউব লাইটের মত একেবারে ফকফকা। আসলে মফস্বলে হলুদ সাংবাদিকতা কি কমবেশী আমরা সবাই জানি বুঝি। কিন্তু বলতে গেলে একটু কৌশলী হতে হয়। হতে হয় চতুর। কারণ অনেকেই গোস্যা করেন। বেতন ভাতা পায়না অথচ প্রেস লিখা স্টিকার লাগিয়ে গাড়ি হাকিয়ে চলছেন। কেউ কেউ আবার প্রশাসনের, আইনের অথবা জনপ্রতিনিধিদের গাড়ীতে করে ঘুরেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের পত্রিকা জনগন কোনদিন হাতে পায়না। আমার কিউরিশাস মাইন্ড জানতে চাই এত অধিক সাংবাদিক গজানোর পিছনে মতলব কি? নিশ্চয় আছে, সাংবাদিক পরিচয়ে এলিট (খানদানি) গোত্রে নাম লিখানো যায়, প্রশাসনের বড় বড় কর্তাদের সাথে হরহামেশায় বাতচিৎ হয় যোগাযোগ স্থাপিত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়া যায়, ভোটকেন্দ্র ও পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকা যায় ইত্যাদি ।

এ কথা সত্য, সাংবাদিকতার অন্যতম বিষয় হল সোর্স তৈরি করা যার মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এই সোর্সকে কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকতার আড়ালে নির্লজ্জ দালালি, লেজুড়বৃত্তি, তদবীর ও ব্যাক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছেন। সবাই না হলেও কেউ কেউ হয়ত করছেন।

যতটুকু বুঝি, মফস্বলে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে নেয়ার সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। অফিস থেকে বেতন তো দেয়না বরং শুরুতে জামানত বাবদ কিংবা সাংবাদিকতার লাইসেন্সটি নবায়ন করার সময় অফিসকে উল্টো মাসোহারা দিতে হয়। তাই অনেকেই জীবিকার তাগিদে সচেতন ভাবেই হলুদ সাংবাদিকতা করছেন। আর এই সব বিপদগামী পথহারা ‘সাংবাদিকদের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা সাধারন মানুষের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হচ্ছেন। বিশুদ্ধ ইলম ছাড়া জোসের বশবর্তী হয়ে অনেকই সাংবাদিকতাই নাম লিখাচ্ছেন। আইচ্ছা সবাইকে সাংবাদিক হতে হবে? পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই ইউনিক ও জিনিয়াস, তাই বলে মাছকে তাল গাছ বেয়ে উঠতে বলা বোকামি। গণমাধ্যম কাজ করা কোন ছেলে মানুষি নয়, সাংবাদিকতা করা কোন তামাশার ব্যাপার নয়। তাই এইসব হলুদ সাংবাদিকতা নামের ঝাড়ফুঁক ও বানমারা বাদ দিয়ে আপাতত ফুটেন।

লেখক: সেলিম উদ্দীন, কক্সবাজার (ঈদগাঁও) প্রতিনিধি :

পাঠকের মতামত: