ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

থামছে না ইয়াবার আগ্রাসন

22-300x177নিজস্ব প্রতিবেদক ::

যেন কোন ভাবেই কক্সবাজারে থামানো যাচ্ছে না মাদকের ভয়াবহতা। অন্যান্য মাদকের পাশাপাশি অপ্রীতিরোধ্য রয়ে গেছে ইয়াবা। কেবল মাত্র জানুয়ারি মাসেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে উদ্ধার হয়েছে ৪ লাখের কাছাকাছি ইয়াবা। এসব অভিযানে আটক করা হয়েছে ৫০ জনের বেশি পাচারকারী। এর আগে ২০১৫ সালে এক বছরে ৫০ লাখের অধিক ইয়াবা সহ ৫ শতাধিক পাচারকারীকে আটক করা হয়েছে। ইয়াবার এ আগ্রাসনের ভয়াবহতায় চিন্তিত রয়েছে বিশিষ্টজনরা।
২০১৫ সালে ইয়াবা সহ অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধারের শীর্ষে ছিলেন বিজিবির টেকনাফের সদস্যরা। যার জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন বিজিবির টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ। একই সঙ্গে জানুয়ারি মাসেও তারা শীর্ষে রয়েছেন।
বিজিবির টেকনাফস্থ ২ নং ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ জানান, জানুয়ারি মাসের অভিযানে বিজিবি সদস্যরা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এসব অভিযানে আটক করা হয়েছে ৩৩ জনকে। পলাতক আসামী রয়েছে ২ জন। এই এক মাসে ২২ লাখ ৫১ হাজার টাকার মূল্যের মিয়ানমার তৈরী বিভিন্ন প্রকার মদ এবং গাঁজা সহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যও জব্দ করা হয়। অন্যান্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযানে আটক করা হয়েছে ৩৪ জনকে।
তিনি জানান, ২০১৫ সালের এক বছরে ৪৪ লাখ ১১৪টি ইয়াবা উদ্ধার ও ২৭০ জনকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার করা ইয়াবার মূল্য ১৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বেশি।
টেকনাফ থানার ওসি আতাউর রহমান খোন্দকার জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে পুলিশ ২০ হাজারের বেশি ইয়াবা সহ ১০ জনকে আটক করেছে। ২০১৫ সালের এক বছরে ৮ লাখ ৬৬ হজার ৪১৯টি ইয়াবা সহ ২৩৮ জনকে আটক করে। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীও রয়েছে। মামলা দায়ের করা হয়েছিল ১৭৪টি।
বিজিবির কক্সবাজারস্থ ১৭ ব্যাটালিয়ের অধিনায়ক লে. কর্ণেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, জানুয়ারি মাসে বিজিবি সদস্যরা এক কোটি ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকার বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে ৩৩ হাজারের বেশি ইয়াবা সহ ৯ জনকে আটক করা হয়। পলাতক রয়েছে একজন।
পুলিশ বিজিবির পাশাপাশি র‌্যাব, কোষ্টগার্ডের অভিযানে ইয়াবা সহ পাচারকারি আটকের ঘটনা রয়েছে। রয়েছে মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ইয়াবা সহ আটকের ঘটনাও।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক সুবোধ কুমার বিশ্বাস জানান, জানুয়ারি মাসের অভিযানে ৭৬ হাজারের বেশি ইয়াবা সহ ৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও ৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেছে ভ্রাম্যমান আদালত।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে কক্সবাজারে অন্যান্য মাদকের আগ্রাসনের মধ্যে ইয়াবার বিস্তার সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদিনের এ ইয়াবার আগ্রাসন রোধে ২০১৪ সালের শুরুতে কক্সবাজারে ইয়াবা বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়। অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে ৬ জন নিহত ও ৮ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়। ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে থাকায় পুলিশের কর্মকর্তা ও কনস্টেবল পর্যায়েও চলে ব্যাপক বদলি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে হতাহতের ঘটনা ও নানা উদ্যোগের পর চিহ্নিত গডফাদাররা পালিয়ে গেলেও ২০১৫ সালে এসে ইয়াবা পাচার ফের বৃদ্ধি পায়। চক্রটি মিয়ানমার থেকে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে ইয়াবা অনুপ্রবেশ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নৌ পথেও ইয়াবা পাচার শুরু করে ব্যাপক হারে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম ঢাকা কেন্দ্রিক নৌ পথে পাচার হওয়া দেশের সবচেয়ে বড় ইয়াবা চালানও উদ্ধার হয়েছে।
মাদকাসক্তদের পূর্ণবাসনে কাজ পরিচালনাকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নোঙর এর পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের মাদকের আগ্রাসনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। সহজলভ্যতার কারণে তা সৃষ্টি হচ্ছে। জেলায় সঠিক কোন পরিসংখ্যান না থাকলে অনুমানিক ৬০ হাজারের বেশি মাদকাসক্ত থাকতে পারে। যার মধ্যে সবেচেয়ে বেশি ইয়াবা সেবনে আসক্ত।
তিনি জানান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের রাজনৈতিক অধিশাখা-৬ এর ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক স্মারক পত্রের সূত্রে মাদকদ্রব্য অধিদফতরের যুগ্ন সচিব ও পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) প্রণব কুমার নিয়োগী স্বাক্ষরিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সহ বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে টেকনাফে ইয়াবা পাচারের ঘটনাটি দীর্ঘদিনের। গত এক যুগ ধরে এ ইয়াবা পাচারের ঘটনাটি দেশব্যাপী নানা আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হলেও কার্যত গডফাদার ধরতে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। আর ওই তালিকায় প্রভাবশালী ৭ জন সহ ৭৬৪ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ইয়াবা পাচার রোধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা, টাস্কফোর্স অভিযান সহ বিশেষ অভিযান পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নজরধারী ও টহল জোরদার, বিজিবি‘র বিওপি এবং চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়ানো, ইয়াবার সাথে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সচেতনতামুলক কর্মসূচি গ্রহণের কথা রয়েছে। এটা সঠিকভাবে করা হলে ইয়াবা সহ মাদক রোধ কিছুটা কমতো।
তিনি উদাহরণ হিসেবে ২০১৪ সালের শুরু থেকে কক্সবাজারে ইয়াবা বিরোধী বিশেষ অভিযানের কথা উল্লেখ করে বলেন,  অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে ৬ জন শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী নিহত ও ৮ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়াও পুলিশের কর্মকর্তা ও কনস্টেবল পর্যায়ে চলে ব্যাপক বদলি। এর পর কিছুদিন ধরে পাল্টে গিয়েছিল দৃশ্য। টেকনাফের শীর্ষ গডফাদারদের কাউকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। কিন্তু পরে কৌশলে এসব চিহ্নিতদের অনেকেই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। ২০১৫ সালের শুরু থেকে আবারো বৃদ্ধি পায় ইয়াবা পাচার। একের পর এক ইয়াবার বড় চালান উদ্ধার হতে থাকে। টেকনাফ কেন্দ্রিক ইয়াবা চক্র সক্রিয় হতে থাকে। তবে পুলিশ বিজিবির অভিযান জোরদার এবং ব্যাপক সংখ্যক ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এতে ইয়াবা চক্রটি নৌ পথকে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর জের ধরে চট্টগ্রাম, আনোয়ারা সহ বিভিন্ন সমুদ্র এলাকা থেকে ইয়াবার বড় চালানও উদ্ধার হচ্ছে। এর জন্য আরো নতুন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন তিনি।
টেকনাফ থানার ওসি আতাউর রহমান খোন্দকার জানিয়েছেন, পুলিশ ও বিজিবি সমন্বয়ে ইয়াবা ও মানবপাচার রোধে নানা কাজ করা হচ্ছে। অভিযানের পাশাপাশি এলাকা ভিত্তিক সচেতনতা কর্মসূচিও পালন করা হয়। এর ফলে মানবপাচার বন্ধের পাশাপাশি কিছুটা হলেও ইয়াবা পাচার কমতে শুরু করেছে।
বিজিবির টেকনাফস্থ ২ নং ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্ণেল আবুজার আল জাহিদ জানান, ইতিমধ্যে ইয়াবা ও মানবপাচার রোধে বিজিবি বিওপি, চেকপোষ্ট বাড়ানো ছাড়াও টহল জোরদার করা হয়েছে। এতে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনাও বেড়েছে। তবে ইয়াবা রোধে সামাজিক প্রতিরোধ তৈরী করতে না পারলে ইয়াবা চূড়ান্তভাবে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই বিজিবি সামাজিক সচেতনতার পক্ষেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

পাঠকের মতামত: