ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বন্ধ হয়ে গেছে টেকনাফ-মংডু সীমান্তবাণিজ্য

teknaf-land-pict  2.6.2016-2অনলাইন ডেস্ক ::

টেকনাফ ও মিয়ানমারের মংডুর মধ্যে সীমান্তবাণিজ্য অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। গত ২৪ আগস্ট থেকে মংডু শহর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে সীমান্ত বাণিজ্যের কোনো পণ্য আসেনি। মংডু টাউনশিপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝি-মাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আটকা পড়েছেন। তবে স্বল্প পরিসরে চলছে টেকনাফ-আকিয়াব সীমান্তবাণিজ্য।

মংডু টাউনশিপের কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের টেকনাফ বন্দরে মালামাল আনতে দিচ্ছে না। সেই সাথে আমদানি-রফতানিকারকদের যাতায়াতও বন্ধ রয়েছে। তবে আকিয়াব (সিটওয়ে) থেকে যৎসামান্য পণ্য আমদানি হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যের চিত্র আরো শোচনীয়। মিয়ানমারের মংডু কর্তৃপক্ষ একতরফা ও অঘোষিতভাবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রাখায় রাজস্ব আয়ে ধস নেমেছে বলে জানা গেছে। টেকনাফ স্থলবন্দর কাস্টমস সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। আগে যেখানে টেকনাফ স্থলবন্দরে প্রতি মাসেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পরও কয়েক কোটি টাকা বেশি আয় হতো, সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছতে পারেনি।

জানা যায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবাণিজ্যের এই পয়েন্টটি ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’ নামে পরিচিত ও পরিচালিত। ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ ও মংডু টাউনশিপে পৃথকভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই থেকে উভয় দেশের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে ‘টেকনাফ-মংডু বর্ডার ট্রেড’। তা ছাড়া বেকারদের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আরাকানে (বর্তমান নাম রাখাইন স্টেট) সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা না হলেও অঘোষিত ও একতরফাভাবে টেকনাফ স্থলবন্দরের সাথে মংডুর সীমান্তবাণিজ্য বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার সরকার। এতে টেকনাফ স্থলবন্দর ব্যবহারকারী আমদানি-রফতানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, শত শত শ্রমিক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি সরকার প্রতিদিন মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

১২ অক্টোবর বিকেলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বন্দরে আগের সেই কর্মচাঞ্চল্য নেই। কিছু ভুয়া পণ্য ও কাঠ আসছে মংডুর বাইরে থেকে। বন্দরের বহির্নোঙরে জাহাজজট নেই। শ্রমিকদের কোলাহল নেই। রাজস্ব আয়সহ আমদানি-রফতানির কাহিল অবস্থা। স্থলবন্দর কাস্টমস সূত্র জানান, আগে প্রতি মাসে প্রায় শত কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি হতো। সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে ১৪১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৪৭ লাখ ২২ হাজার ৬৬২ টাকার পণ্য। এতে রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৬৭ লাখ ১৬১ টাকা। এ মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্ধারিত মাসিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৯ টাকা কম আয় হয়েছে।

রফতানি বাণিজ্যের চিত্র আরো শোচনীয়। আগে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার শতাধিক চালানে বিভিন্ন প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মংডু টাউনশিপে রফতানি হতো। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে মাত্র ১৬টি চালানে ৩৭ লাখ ৯১ হাজার ৮৯২ টাকার সাত প্রকারের বাংলাদেশী পণ্য রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চারটি চালানে ২৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৩ টাকার ৪৪.৪৮ মেট্রিক টন বাংলাদেশী গেঞ্জি, তিনটি চালানে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬০ টাকার ১.৯২ মেট্রিক টন মানুষের চুল, তিনটি চালানে ৯ হাজার ৮১০ টাকার ০.০৮ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ, দুইটি চালানে ৭ লাখ ৩ হাজার ৫০ টাকার ৫.৯ মেট্রিক টন ফাইস্যা মাছ, একটি চালানে ৩০ হাজার ৬৫৬ টাকার ০.৭৫ মেট্রিক টন চিপস, দুইটি চালানে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৭৭৫ টাকার ০.৮২৫ মেট্রিক টন ফিসিপলেটস, একটি চালানে ৬১ হাজার ৫৫৮ টাকার ১.৫ মেট্রিক টন জুট ব্যাগ।

তবে কোরবানির ঈদের মাস হওয়ায় গবাদিপশু আমদানি খাতে আয় ভালো হয়েছে। ঈদের আগে থেকেই বৈধ ও অবৈধ পথে গবাদিপশু এসেছে অনেক। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গবাদিপশু আমদানির জন্য টেকনাফের হ্নীলা ও শাহপরীর দ্বীপ দুইটি ক্যাডল করিডোর রয়েছে। তন্মধ্যে হ্নীলা করিডোর দিয়ে কোনো গবাদিপশু আমদানি হয়নি। শাহপরীর দ্বীপ ক্যাডল করিডোর দিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে গবাদিপশু আমদানি হয়েছে ৯ হাজার ৯৪২টি। এর মধ্যে ৬ হাজার ৯৪৬টি গরু, ৪৩০টি মহিষ, ২ হাজার ৫৬৬টি ছাগল। প্রতিটি গরু ও মহিষ ৫০০ টাকা এবং ছাগল ২০০ টাকা হারে এ খাতে মোট রাজস্ব আয় হয়েছে ৪২ লাখ ১ হাজার ২০০ টাকা।

এ দিকে টেকনাফ-মংডু সীমান্তবাণিজ্যের আওতায় মংডু টাউনশিপ থেকে পণ্য নিয়ে এসে মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝিমাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আটকা পড়েছেন। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে ২৪ আগস্ট রাতে সহিংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এরা ভয়ে গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে স্বদেশে ফিরতে পারছেন না বলে জানা গেছে। মিয়ানমার নাগরিক ৪৪ জনের মধ্যে ৪৩ জনই মুসলমান এবং একজন হিন্দু। এদের সকলের বাড়ি মিয়ানমারের মংডু টাউনশিপের নোয়াপাড়া, উকিলপাড়া, নাপিতের ডেইল, সুধাপাড়া, খাঁরিপাড়া, ফয়েজিপাড়া, মন্নিপাড়া এবং দুই সহোদরের বাড়ি বলিবাজার গ্রামে।

আটকে পড়াদের একজন মংডু টাউনশিপের নোয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত আমির হামজার ছেলে জামাল হোসেন মাঝি (৬০)। তিনি বলেন, ‘আমরা ২৪ আগস্ট মংডু থেকে ১৩টি কার্গো ট্রলারে মালামাল বোঝাই করে ৪৪ জন মাঝিমাল্লা টেকনাফ স্থলবন্দরে আসি। মালামাল খালাস করে ২৫ আগস্ট মংডুতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। বাণিজ্যের মালামালও যথাসময়ে খালাস হয়েছিল। কিন্তু রাতে সহিংস ঘটনার কারণে ভয়ে দেশে ফিরে যাইনি। বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস ও টেকনাফের ব্যবসায়ীরা আমাদের যথেষ্ট দেখাশুনা করছেন, খোঁজখবর রাখছেন। মোবাইল ফোনে পরিবারের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কয়েকজনের পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সাধারণ মাঝিমাল্লা। আমরা যাদের মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলাম তারা মংডু টাউনশিপের বড় বড় ব্যবসায়ী। তাদের মধ্যে মুসলমান ও রাখাইন উভয়ই রয়েছেন। তারা মংডু এলাকার ধনী লোক। তারা আমাদের মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্র্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু এখনো রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট এলে ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে স্বদেশে ফিরে যাব।’

টেকনাফ স্থলবন্দরের জিএম জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আকিয়াব থেকে কিছু পণ্য আসছে। ২৪ আগস্টের পর মংডু থেকে কোনো পণ্য আসেনি। কবে পুনরায় আসা শুরু হবে তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন শাখা বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের ১৩টি কার্গো ট্রলার এবং ৪৪ জন রোহিঙ্গা মাঝিমাল্লার ২৪ আগস্ট থেকে আটকে পড়ার কথা নিশ্চিত করে বলেন, ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। আগামী কিছু দিনের মধ্যে মংডু থেকে মালামাল আসা শুরু হবে বলে শোনা যাচ্ছে’।

পাঠকের মতামত: