ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গায় সাবধান আওয়ামী লীগ

Tofaiel_1তোফায়েল আহমদ ::

রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা, নারী ধর্ষণ ও ঘর-দুয়ার জ্বালিয়ে দেয়া সহ হরেক রকমের জঘন্য ঘটনা যতই না ঘটুক-একাত্তরের পাকি বর্বরতার সাথে তুলনীয় কিছুতেই নয়। মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদের উপর ক্ষীপ্ত। রোহিঙ্গাদের দাবি তারা মুসলমান হবার কারনেই নিপীড়নের টার্গেট হয়েছেন। তাই বিশ্বব্যাপি মুসলমানদের উপর যে নিপীড়ন চলছে হয়তোবা তারই ধারাবাহিকতা।

কিন্তু পাকিরা মুসলমান হয়েও একাত্তরে বাঙ্গালী মুসলমানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে একবারও পিছপা হয়নি। বাঙ্গালীদের স্বল্প সংখ্যক সংখ্যালঘু ছাড়া শতকরা আশি/নব্বই জনই মুসলমান। তবুও পাকি বর্বর সেনারা একাত্তরে মুসলমানদের নিধন করতে নেমেছিল সর্বশক্তি দিয়ে।

সেই বর্বর পাকি সেনারা একাত্তরে হত্যা করেছিল ত্রিশ লাখ বাঙ্গালীকে। দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুন্ঠন করেছিল পাকিরা সহ এদেশীয় রাজাকার, আলবদর-আল শামস বাহিনী। তাই সেই একাত্তরের দিনটির কথা মনে পড়লে দেশের মাটি ও মানুষের কথা ভাবনায় আসে।

গতকাল সোমবার সাত-সকালে নাফ নদী তীরের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া সীমান্তে যে সব অজানা-অচেনা লোকজন ভীড় করেছিলেন তাদের কথা শুনেই মনে পড়ে গেল এদেশের একাত্তরের কথা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি কার না দয়ামায়া নেই ? জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্যাতিতদের কথা শুনে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তিনি কেঁদেছেন রোহিঙ্গাদের জন্য।

বাঙ্গালী আবেগ প্রবণ। প্রধানমন্ত্রীর চোখের পানিতেই এদেশের মানুষের মনও গলে গেল। সবাই ছুটছেন সাহায্যের হাত নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে। গাড়িতে গাড়িতে ত্রাণ। সবারই পথ রোহিঙ্গা শিবির। দলমত নির্বিশেষে মানুষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রতি। সেই যে সাত সকালে রোহিঙ্গা শিবিরে ছুটে গিয়ে সন্ধ্যায় আবার ফিরে সংবাদ পাঠানোর কাজটি করতে গিয়েই আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছি।

অনুরুপ সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আমার সহপাঠি, রাজনীতিবিদ এবং পেশাজীবিরাও রোহিঙ্গা শিবিরে যাতায়াত করতে করতে এক প্রকার হয়রান হয়ে পড়েছেন। রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের সরকার প্রধানের মানবিক দৃষ্টিকোণের বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর এখনকার খবর বড়ই ইতিবাচক। যা সাম্প্রতিক সময়ে এদেশটির কোন বিষয় নিয়েই এরকম আলাপ-আলোচনায় উঠে আসেনি।

অথচ সরকারের একটি মানবিক বিষয় নিয়েই এদেশের মহল বিশেষ বরাবরের মতই সুযোগ নিচ্ছে। এমন সুযোগে সীমান্তবর্তী এলাকায় মহল বিশেষের আসা-যাওয়াটাই পুরোপুরি সন্দেহজনক। এমনকি টেকনাফের শাহপরির দ্বীপের দুটি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা বিষয় নিয়ে যা চলছে তাও রিতীমত উদ্বেগজনক। একটি মাদ্রাসার একজন হুজুরের সাথে আমার আলাপও হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন-তাদের একটি বড় তহবিলের দরকার। তহবিলের জন্য এটাই মোক্ষম সুযোগ।

হুজুর জানালেন, দেশের নানা এলাকা থেকে শত শত হুজুরগন এখানে এসে রাতে অবস্থান নেন। তাদের জন্য প্রতি রাতে একটি নয়-মাঝে মধ্যে ২টি গরুও জবাই করতে হয়েছে। তহবিলের টাকা এমনিতেই এসে যায়-বলেন হুজুর। তুরষ্ক থেকে আসা মেহমানরা এক রাতে প্রতি রোহিঙ্গা পরিবার পিছু ২০ হাজার টাকা করে ঢালেন। আরাকানে সেই খবর দ্রুত পৌঁছে যায়। কে আর রুখতে পাওে রোহিঙ্গাদের।

পরের দিনই রোহিঙ্গার ঢল নামে শাহপরির দ্বীপের ঘাটে। খবর পেয়ে আমরাও ছুটি। রোহিঙ্গা নারীর নির্যাতনের মানবিক কাহিনী ছাপি। কাঁদে পাঠক। কিন্তু তারা কেউই জানেন না-এসব রোহিঙ্গাদেরই একটি বড় অংশ কেন আসছেন। রোহিঙ্গাদের আনার নেপথ্যে কে ? রোহিঙ্গাদের জড়ো করে টাকা ও ত্রাণ বিলির ভিডিও পাঠানো হয় বিদেশে। সেই ভিডিও’র ছবি দেখে শেখরা কত অংকের টাকা দিচ্ছে এখবর কেউ কি রাখেন ?

সেই শাহপরির দ্বীপের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রোহিঙ্গা আনার দালালি সহ রোহিঙ্গাদের সোনা-দানা কেড়ে নেয়ার দায়ে ৬ মাসের দন্ড নিয়ে এখন কারাগারে আটক। কিন্তু তারপরেও বন্ধ হয়নি রোহিঙ্গা আনার কাজটি। রবিবার রাতে শাহপরির দ্বীপে কর্মরত একজন গোয়েন্দা কর্মী নিজেই হতবাক হয়ে জানালেন-আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অজানা-অচেনা দেশের নানা প্রান্তের লোকজন নৌঘাটে এসে রোহিঙ্গাদের হাতে হাতে টাকা ধরিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি কে কতজন রোহিঙ্গা এনেছে সেই রকম হিসাব করেও নৌকার মাঝি-মাল্লাদের বখশিষও দিচ্ছেন।

অনেক আগে থেকেই জানতাম রোহিঙ্গারা টাকা আয়ের বড় এক পণ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয় মহল বিশেষের কাছে। ১৯৭৮ সাল থেকে আমি রোহিঙ্গা বিষয়ক সংবাদের কাজ করতে গিয়ে এ বিষয়ক নানা কথা জানি। অনেক কথা লিখছি না। কুতুপালং শিবিরের পশ্চিমে লম্বা শিয়া এবং মধুরছড়া নামক এলাকাটি বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এখানকারও নানা উদ্বেগজনক খবর শুনতে পাওয়া যায়। নাফনদ তীরে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা নিজেরাই স্থাপন করেছে রোহিঙ্গা শিবির।

গতকাল সোমবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই আশংকা ব্যক্ত করেছেন-ইয়াবা ও অস্ত্রের চালান সহ সন্ত্রাসীদের কথাটি। এমন আশংকা বাস্তবেও রুপ নিয়েছে। যেমন রবিবার রাতেই ত্রিশ হাজার পিস ইয়াবার চালান উদ্ধার হয়েছে রোহিঙ্গাবাহি নৌকার নামানো পুটলি থেকে। সেই সাথে উদ্ধার হয়েছে বিদেশী সিগারেটও।

আমরা সবাই জানি আওয়ামী লীগ রোহিঙ্গা ইস্যুতে এই প্রথম। রোহিঙ্গায় দলটি কেবল মানবিকতা দেখেছেন। ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালের রোহিঙ্গা ইস্যু ছিল বিএনপি’র। বিএনপি বরাবরই রোহিঙ্গায় নমনীয়। এমন নমনীয়তার সুযোগ নিয়েই সেই মহল বিশেষ বিএনপিকে রোহিঙ্গায় এক প্রকার ডুবিয়েছে। আওয়ামী লীগ হয়তোবা এখনো মানবিকতায় রয়েছে। আর ক’দিন পর বুঝবে তারাও। যখন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ‘শরনার্থী’ ঘোষণার চাপ দেবে এবং ঠ্যাঙ্গারচরে সরাতে বাঁধা দেবে তখনই বুঝবে কত ধানে কত চাল।

বিএনপি নমনীয় না হলে ১৯৯১ সালের ২১ ডিসেম্বর রেজু পাড়া সীমান্তের বিওপিতে মিয়ানমারের হামলার ঘটনাটিও ঘটতা না। সেটা না ঘটলে সেই সময়ে ঘটত না বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার আগমণও । আর রোহিঙ্গা না আসলে এদেশে ঢুকতে পারত না ইউএনএইচসিআর সহ রোহিঙ্গাপ্রেমী বলে পরিচিত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাগুলো। সেই সাথে এরকম দীর্ঘমেয়াদী রোহিঙ্গা সমস্যাও আজ আমাদের বয়ে বেড়াতে হতনা। অতএব সাবধান আওয়ামী লীগ।

 

পাঠকের মতামত: