ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

রাখাইন রাজ্যের পথে পথে লাশ আর লাশ, ‘হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হচ্ছে বোমা ও গুলি

Coxs rohingha 05.09.2017.3রোহিঙ্গার স্রোত থামছেই না। গতকাল শাহপরীর দ্বীপ এলাকা থেকে তোলা ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::

‘হেলিকপ্টার থেকে বোমা ছোড়া হচ্ছে। গুলিও চলছে। বিপদ দেখে বুচিডংয়ের মনুপাড়ার রোহিঙ্গারা এক উঠানে জড়ো হয়ে পালানোর উপায় খুঁজছিল। হঠাৎ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলি। এ সময় অনেকে দৌড়ে পালিয়ে গেলেও বাকিদের ঘিরে ফেলে ২৫-৩০ জন আর্মি। তাদের মধ্যে মেয়েদের উঠান থেকে ধরে আশপাশের বিভিন্ন ঘরে নিয়ে যায় আর্মিরা। অনেক রোহিঙ্গাকে সেখানে হত্যাও করে। ‘

গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে উখিয়ার ট্যাংখালী এলাকায় এমন তথ্য দিচ্ছিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নূরুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা যুবক। গত রবিবার রাতেই বাবা নূর আলী (৬৫) ও মা আনছার বেগমসহ নূরুল আমিনের পরিবারের ১০ জন শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত হয়ে তাঁরা কুতুপালংয়ে আসেন।

নূরুল আমিন বলেন, ‘ব্যা জং নামে এক সেনা সদস্যের সন্তানকে বাসায় গিয়ে পড়াতেন মনুপাড়ার স্কুলশিক্ষক মো. সেলিম (৪০)। ওই শিক্ষককে ব্যা জং ওই প্রায় ৩০০ জনের মধ্যে নিজেই হত্যা করেছে।

‘গতকাল দুপুরে ট্যাংখালী থেকে ছোট বোনকে নিয়ে নয়াপাড়ার ক্যাম্প এলাকায় আসার সময় অটোরিকশা যাত্রী নূরুল আমিন সে দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়নের এসব কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘দৌড়ে পাশের একটি বাড়ির পেছনের ঝোপে লুকিয়ে থাকি। ওখান থেকে আমরা গণহত্যার ঘটনাটি দেখেছি। সন্ধ্যার দিকে সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর আমার আব্বু বলেন, ওরা (আমার আত্মীয়স্বজন) এখানে আছে কি না চল দেখে আসি, সেখানে গিয়ে দেখি কেউ বেঁচে নেই। জাহেদ হোসেন (৫৫), তাঁর ছেলে নূরুল ইসলাম (১৭) ও মো. সালাম (২০)। মৌলভি আবদুল খালেক (৮৫) ও তাঁর ছেলে মো. সাদেকসহ আমাদের ১০ জন আত্মীয়কে গুলি করার পর জবাই করেছে। ১২ দিন বুচিডং ও মংডু জেলার কুন্দুপাড়া খাল, কুরমি খাল, নাফ নদী, কালা পাহাড়সহ (হাজার ফুট উচ্চ) তিনটি পাহাড় বেয়ে এ দেশে আসি। ’ দেরিতে আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মনে করেছিলাম কিছুদিন গেলে পরিস্থিতি শান্ত হবে। কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে আসার পথে বিভিন্ন স্থানে লাশ দেখেছি। অনেক এলাকায় লাশ পচে গন্ধ বের হচ্ছে। আমরা সোজা রাস্তা দিয়ে আসতে পারিনি। নালা, খাল, বিল, নদী ও পাহাড় বেয়ে আসার কারণে দেরি হয়েছে। ’গতকাল বিকেল ৪টার দিকে টেকনাফ বাজারে একটি পেট্রল পাম্পের সামনে রাখাইনের মংডু থেকে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়েছে। রোহিঙ্গা নারী আমেনা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী (সাব্বির আহমদ) প্রাণভয়ে ওই দিক থেকে আসেননি। সেনাবাহিনী যুবকদের দেখলে গুলি করছে। তাই ওখানে পালিয়ে আছে। নজির আহমদের স্ত্রী ছমিয়া (২৫), হারুনুর রশিদের স্ত্রী ছামিয়াও একই কারণে স্বামীকে রেখে সন্তানদের নিয়ে এসেছেন বলে জানান।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পথে পথে এখন লাশ আর লাশ। কারো গলা কাটা, কারো হাত কাটা, কারো পা কাটা। বীভৎস লাশের স্তূপ পড়ে রয়েছে পথে-ঘাটে, নদী-নালায়, ধানক্ষেতে। তমবাজারের নাইসংপ্রাং গ্রাম থেকে দীর্ঘ ১২ দিন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পরিবারের ১৪ সদস্য নিয়ে গতকাল সকালে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা নাগরিক সত্তরোর্ধ মোহাম্মদ জাকারিয়া ও তাঁর ছেলে মো. ওমর ফারুক এ তথ্য দেন। তাঁদের সঙ্গে কথা হয় উখিয়ার বালুখালী (নতুন) রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী আশ্রয়শিবিরে। গতকাল সকালে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাং পয়েন্ট দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশে আসেন। তাঁরা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের বর্বরতা ২৫ আগস্ট থেকে থেকে শুরু হলেও তা ছিল আনুষ্ঠানিকতা বা ঘোষণা দিয়ে। এরও আগে (প্রায় এক মাস আগে) থেকে সেনারা রাখাইন রাজ্যের তমবাজারের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত নাইসংপ্রাং গ্রামটি ঘিরে ফেলে। ওই সময় হত্যাযজ্ঞ শুরু না করলেও এলাকা ছেড়ে চলে যেতে নানাভাবে হুমকি ও মারধর করা হয়েছে তাঁদের।

বৃদ্ধ জাকারিয়া বলেন, ‘সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা আমার দুই ভাইকে গুলি ও জবাইয়ে হত্যার পর লাশ ধানক্ষেতে ফেলে দেয়। তাই আর আর দিনেরবেলায় সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীদের চোখ এড়াতে পাহাড়েই অবস্থান করতে থাকি। প্রতিদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার পর দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে বাংলাদেশের পথে রওনা করতে থাকি। এভাবে কয়েক দিন হেঁটে আসার সময় পুত্রবধূর ভাই অনাহারে এবং আরেক সদস্য অসুস্থ হয়ে মারা পড়ে। ’

জাকারিয়া নিজেদের ভাষায় জানান, তমবাজারের নাইসংপ্রাং গ্রাম থেকে সড়ক বা নদীপথ দিয়ে বাংলাদেশে আসতে মাত্র দুই দিন সময় লাগে। কিন্তু সড়কপথে মিয়ানমার সেনা এবং রাখাইন সন্ত্রাসীরা অবস্থান করায় কৌশল পাল্টে দুর্গম পাহাড়ি পথ দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই জান খোয়ানোর ভয়ে। সেখানেও দুই ভাইকে রক্ষা করতে পারেননি। আবার পরিবারের আরো দুই সদস্যের একজন অনাহারে ও অন্যজন অসুস্থ হয়ে মারা যায়। ওমর ফারুক বলেন, ‘মগ সেনা ও সন্ত্রাসীরা আমাদের দুই চাচাকেও গুলিতে এবং কুপিয়ে হত্যা করে লাশ ধানক্ষেতে ফেলে দেয়। হয়তো গ্রামের নিখোঁজ থাকা অনেক নারী-পুরুষকেও একই অবস্থা করেছে তারা। ’

বাবা জাকারিয়া ও ছেলে ওমর ফারুকের আক্ষেপ, দীর্ঘ ১২ দিন দুর্গম পাহাড়ি পথ হেঁটে বাংলাদেশে আসতে পারলেও এখনো মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই হয়নি। একপর্যায়ে বৃদ্ধ জাকারিয়া চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠেন—‘ওহ আল্লাহ, তোঁয়ার জমিনত আঁরে ইন কী দেহাইলা। ইন দেহাইবার আগে আরে মারি ক্যা ন ফেলঅ। ’ অর্থাত্ হে আল্লাহ, তোমার দুনিয়ায় এসব কী দেখলাম। এসব দেখার আগে আমাকে কেন মারলা না।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং থেকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা কক্সবাজারের টেকনাফ যাওয়ার পথে পথে দেখা যায় রোহিঙ্গাদের ভিড়। ওই দূরত্বের প্রায় ৫০ কিলোমিটার মূল সড়কের মোড়ে মোড়ে লাখো রোহিঙ্গাকে দেখা গেছে। ক্ষুধায় দিশাহারা এসব মানুষ ত্রাণ দেখলে সেখানে দৌড়ে আসছে। রাখাইনে এখনো রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা বন্ধ হয়নি তা আরো বেড়ে যাচ্ছে বলে সেখান থেকে আসা রোহিঙ্গারা জানায়।

পাঠকের মতামত: