ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

টেকনাফ ও উখিয়ায় তিন শতাধিক দালাল সক্রিয়

10.09.2017.1শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার ॥

জাতিগত সহিংসতা আর বর্বর নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সর্বস্ব হারানো রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর থেকে এপাড়ে এসেও রেহায় মিলছে না। কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের নিয়েই তিন শতাধিক দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। নৌকা ভাড়া করে মিয়ানমারের ভুখন্ড থেকে রেহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসা, যানবাহন ভাড়া করে দেয়া, বিভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া, বসবাসের জন্য জমির ব্যবস্থা করা, রোহিঙ্গা নারীদের স্বর্ণালংকার ও জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়া,কম মুল্যে মিয়ানমারের মুদ্রা ‘কিয়াত’ কেনা -বেচা গত ১৫ দিন ধরে অনেকেরই পেশায় পরিনত হয়েছে। এর পাশাপাশি অপর এক শ্রেনীর দূর্বৃত্ত রোহিঙ্গাদের জিম্মি করেও মোটা অংকের টাকা আদায় করে যাচ্ছে। টেকনাফ শহর সহ বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করেও দমানো যাচ্ছে না দালাল চক্র।

ইতোমধ্যেই তারা রোহিঙ্গাদের দালাল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। টেকনাফের বাসস্ট্যান্ড, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, খুরের মুখ, বাহারছড়া, শামলাপুর, নাইটপাড়া, উনচি প্রাং, হোয়াইক্ষ্যং, মুচনী, লেদা, লম্বাবিল, বালুখালি, পালংখালী, থাইনখালি, উখিয়া কুতুপালং সহ রোহিঙ্গাদের যে সব স্থানে সমাগম ঘটছে সেখানেই এই দালালরা সক্রিয় রয়েছে। প্রায় তিন শতাধিক ‘দালাল’ এসব অপকর্মে সক্রিয় রয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

টেকনাফের স্থলপথের শেষ সীমানা শাহপরীর দ্বীপ। খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ এলাকার বাসিন্দা ও ট্রলার চালক সিরাজের শ্বাস ফেলার সুযোগ নেই। বেলায় আড়াইটার দিকে ১৪ জন রোহিঙ্গাকে এইমাত্র মিায়ানমার থেকে নিয়ে এই মাত্র দ্বীপে পৌঁছেছেন। ট্রলার থেকে শিশুসহ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষরা নেমে যাওয়ার কয়েক মিনিট সময়ের মধ্যেই কথা হয় তার সঙ্গে। সিরাজ জানালেন, ‘সময় নেই।

এখনই আবার তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী নুরুল্লাাপাড় ও কুইন্নাপাড়ার কাছে যাবে। সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা এপাড়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের নিয়ে আসতে হবে’। একথা বলেই সে ট্রলারের দিকে ছুটে গেলেন। তার এক সহকর্মী গ্যালনে ভরে ট্রলারের জ্বালানী নিয়ে এসেছেন।

এগুলো ট্রলারে তুলেই সিরাজ আবার মিায়ানমারের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সিরাজের ট্রলারের মতো একের পর এক মাছ ধরার ট্রলার শহপরীর দ্বীপ এলাকায় রোহিঙ্গাদের আনা-নেওয়া করছে। শুধু মাছ ধরা ট্রলারই নয়, ছোটবড় ইঞ্জিন চালিত নৌকাও রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, এই ট্রলার বা নৌকার দালালরা সীমান্তের কাছকাছি পৌছে রোহিঙ্গাদের ফুসলিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের আনা-নেয়ার জন্য এই দালাল সিন্ডিকেটের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় প্রায় ৩০০ ট্রলার ও নৌকা রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের ভাষ্য হচ্ছে, ‘এই সুযোগ সব সময় আসে না। একারনে অল্প সময়ে বেশী টাকা আয় করার জন্য মাছ ধরা বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।’ একই অবস্থা দেখা গেছে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সংলগ্ন বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায়। এখানেও অনেক ট্রলার রোহিঙ্গাদের আনা নেওয়ার কাজে রয়েছে গত এক সপ্তাহ ধরে।

ট্রলার দালাল সিন্ডিকেটের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করছে। টাকা দিতে না পারলে নৌকা থেকে একজনকে জিম্মি করে রাখা হয়। পরে টাকা দিয়ে ওই ব্যক্তিকে মুক্ত করে নিয়ে যাওয়ার একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিন আগে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে ৬ জন দালালকে আটক করে। পরে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন সাজা দেয়ার পর শামলাপুরে কিছুটা দালাল তৎপরতা কমছে, বলছেন স্থানীয়রা। এই শামলাপুরে নেতৃত্ব দিচ্ছে শহীদ, মৌলভী রফিক, মৌলভী আজিজ, জহুর আলম, নুরুল আলম সহ অর্ধশত দালাল। শামলাপুর এলাকার বেশির ভাগ বোট মালিক এখন দালালের ভুমিকা পালন করছে।

টেকনাফের সাবরাং এলাকার বদু নামের এক দালালের নেতৃত্বে এসব অপকর্ম চলছে। বদুর সঙ্গে আরো ২০/৩০ জন রয়েছে। আবার কোন কোন নৌকা ১০ হাজার থেকে পনের হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে।

শামলাপুর বাজারের রোহিঙ্গা জাহাঙ্গীর জানায়, বাহাইল্লা নামে তার পরিবারের এক সদস্যকে ৩০ হাজার টাকার জন্য বদুর লোকজন শাহপরীর দ্বীপে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের কাছে টাকা ছিল না। তাই দিতে পারেনি। টাকা সংগ্রহের পর ০১৮৩৬১৫৭৩৩১ মোবাইল নম্বরে ফোন করতে বলেছে। একারনে একজনকে রেখে অন্যদের ছেড়ে দিয়েছে।

নদীর ঘাটেও অপর এক শ্রেনীর দালাল সক্রিয় রয়েছে। যানবাহন ভাড়া করে টেকনাফ বাস টার্মিনাল পর্যন্ত পৌছে দেয়া তাদের কাজ। এই দালালরা ও রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে মিায়ানমারে মুদ্রা হাতিয়ে নিচ্ছে। সিএনজি, ইজিবাইক, চান্দের গাড়ি ও পিকআপে তুলে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। অপর একটি দালাল চক্র টেকনাফ বাসস্ট্যান্ড ঘিরে সক্রিয় রয়েছে। ক্যাম্পগুলো কোথায় তা বাসস্ট্যান্ডে আসা রোহিঙ্গারা জানে না। তখন দালালরা রোহিঙ্গাদের ফুসলিয়ে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেয়। মাথাপিছু ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা চুক্তিতে রাজি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক অথবা গাড়ি নিয়ে আসে। এরপর সবাইকে তুলে পাহাড় ও বনভুমিতে নিয়ে ছেড়ে দেয়। যারা টাকা দিতে পারে না, তারা এখনো রাতের পর রাত মার্কেটের বারান্দা, মসজিদের সামনে, গাছের নিচে, রাস্তার পাশে অপেক্ষার প্রহর গুণছে।

পাহাড়ে ও বনবিভাগের জমির কাছেই দালালদের অপর একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ট্রাক থেকে রোহিঙ্গারা নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে দালালরা ঘিরে ধরে। ৮ ফুট বাই ১০ ফুট সরকারী জমি দেয়ার বিনিময়ে এই দালাল চক্রের সদস্যরা ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রইক্ষ্য এলাকায় জমি দেয়ার নামে ৬০ জনের একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা ৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। মাসেও টাকা দিতে হবে বলে আগেভাগেই রোহিঙ্গাদের জানিয়ে দিয়েছে। এই সিন্ডিকেটের কাছে টাকা দিতে না পারলে সেখানে ঘর বা থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না।

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে খবর নিয়ে জানা গেছে,সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন ডানো এই দালাল সিন্ডিকেটের অন্যতম নেতা। শাহপরীর দ্বীপ, হাড়িয়াখালি, এলাকা থেকে তীওে ওঠা রোহিঙ্গারা তার জিম্মায় থাকে। এই সিন্ডিকেটে আছে টেকনাফের আলম, ফরিদ, বাবুল, সিরাজ, রফিক, জয়নাল ও শাহ আলম, কুতুপালংয়ে হাফেজ, হাসান, নুর হাসান সিন্ডিরেকট অন্যতম। শামলাপুর এলাকার জহুর আলম, মৌলভী আজিজ, মৌলভী রফিক ও বদুর নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। এদের লোকজনই বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে রমরমা বানিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে দালাল চক্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। এখানে দালাল আছে। তবে আমরা তাদের ছাড় দিচ্ছি না। দালালদের তৎপরতা প্রতিরোধে আমরা কাজ করছি। ইতিমধ্যেই ২৫ দালালকে গ্রেপ্তার করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে তাদের সাজাও দেয়া হয়েছে। দালাল প্রতিরোধের জন্য আমরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে দালালির প্রমান পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

পাঠকের মতামত: