ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গা ঢল ! দেড় লাখ ছড়িয়ে গেছে

hohফারুক আহমদ, উখিয়া ॥

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতায় সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে। হাজার থেকে এখন কয়েকলাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং,বালুখালী,(বালুখালীর ঢালা),থাইংখালী তাজনিমারখোলা পাহাড়,পালংখালী বাঘঘোনা পাহাড়, টেকনাফের লেদা,নয়াপাড়া, মুছুনি, শামলাপুর ও ঘুমধুম তুমব্রু সীমান্ত এলাকায়। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এক শ্রেনির সুবিধাভোগী স্থানিয় রাজনৈতিক নেতারা অর্থযোগান দিচ্ছে। কুতুপালং, বালুখালী ছাড়াও উখিয়ার বালুখালীর ঢালা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা ও বাঘঘোনাতে বনবিভাগের জায়গার উপর সমাজিক বনায়ন কেটে রাতারাতি ৩টি নতুন বস্তি গড়ে তুলেছে। উক্ত বস্তি গুলোতে প্রায় ১লাখের বেশি রোহিঙ্গা গত কয়েকদিনে আশ্রয় নিয়েছে বলে স্থানিয়রা দাবি করছে। এদিকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত থাকায় কুতুপালং,বালুখালী ক্যাম্পগুলোয় স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ফলে ক্যাম্পে ঠাঁই মিলছে না অধিকাংশের। তারা রাস্তা-ঘাট,দোকান-পাটসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। এককথায় রোহিঙ্গা ভারে নুয়্যে পড়েছে উখিয়া-টেকনাফ।

গতকাল দুপুরে বানন্দবান নাইক্ষ্য ছড়ি উপজেলার, ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম ইউনিয়নসহ ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা জুড়ে সীমান্তের জিরোপয়েন্টে এখনও পযর্ন্ত প্রায় ৫০/৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য অপেক্ষায় আছে। আজকেও প্রায় ৭/৮হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তাছাড়া মিয়ানমারের পুরমা নদীর পাড়েও দেড় লাখ মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। নদীতে পাহাড়ী ঢলের ¯্রােত থাকার কারনে তারা নদী পার হয়ে আসতে পারছেনা। তিনি আরও বলেন, সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা খুবই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্য ও পানি সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের একটি নিদৃষ্ট স্থানে নিয়ে পুনঃবাসন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

সরেজমিন বানন্দরবান নাইক্ষ্যছড়ি সীমান্ত এলাকা তুমব্রু,ঘুমধুম,কোনাপাড়া,মধ্যমপাড়া,পাথরকাটা,রেজুআমতলী,আছার বাগান,জলাপাইতলী,কলাবাগান,গর্জনবনিয়া,কেউয়াছড়ি,পাথরা ঝিরি,বাইশছাড়ী, আজুখাইয়া ও উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া, নলবনিয়া,রহমতেরবিল,ধামানখালী,বালুখালীর ঘাট সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা দলে দলে আসতে দেখা গেছে। দলে দলে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কুতুপালং,বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকেই রাস্তার ধারে ধারে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। অনেকে আবার ত্রাণের আশায় ছুটছে।

কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে,ক্যাম্পের প্রবেশ দ্বার দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা ঢুকছে। কারও হাতে সন্তান, কারও হাতে হাড়ি-পাতিলসহ ছোটখাটো আসবাবপত্র। এসব রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। কার আগে কে পৌঁছবে-এই প্রতিযোগিতা তাদের মাঝে। কারণ যে আগে যাবে সে ঠাঁই পেতে পারে। এদিকে কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের পরিধি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে গভীর বনে প্রবেশ করছে ক্যাম্পের ঝুঁপড়ি ঘর। এরপরও স্থান সংকুলান হচ্ছে না তাদের। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা রাস্তা, বন্ধ দোকানপাট, স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন। এসব লোকজনের পয়ঃনিষ্কাশন থেকে শুরু করে নানা দুর্ভোগে পড়েছে তারা। স্যানিটেশন ব্যাবস্থা নাথাকার কারনে দিন দিন পরিবেশ মারক্তক আকার ধারণ করেছে।

এদিকে মিয়ানমারে সহিংসতায় নতুন করে ঠিক কতজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে এর কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই প্রশাসন সহ কারও কাছে। তবে গত চারদিন পূর্বে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) ও জাতিসংঘের হিসাবে ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে দাবি করেছে। স্থানিয়রা এই সংখ্যা দেড় লাখ পেরিয়ে গেছে বলে ধারনা করছে।

কুতুপালং ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধরণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুর বলেন, ‘ক্যাম্পের কোথাও জায়গা নেই। শুধু রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রবেশ করছে। ছোট একটি ঝুঁপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকছে ১০-১৫ জন। এতেই তাদের সংকুলন হচ্ছেনা। এখন পর্যন্ত শুধু কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পেই অবস্থান নিয়েছে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।’

উখিয়ার বালুখালী অনিবন্ধিত ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি লালু মাঝি বলেন, ‘এই ক্যাম্প এখন কানায় কানায় পূর্ণ। আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দেওয়া এখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ক্যাম্পে কোথাও জায়গা না পেয়ে অনেকে খোলা আকাশে নিচে রাত কাটাচ্ছেন।’ গত দুই দিনে বালুখালী ক্যাম্পে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ প্রবেশ করেছে বলে জানান তিনি।

এদিকে বালুখালী ঢেলায় কমপক্ষে ৬০ হাজার,থাইংখালী তাজনিমারখোলায় ১৫ হাজার থাইংখালী বাঘঘোনায় ২৫হাজার মতো রোহিঙ্গা বনবিভাগের কয়েক হাজার একর সমাজিক বনায়ন দখল করে রাতারাতি ঝুঁপড়ি নির্মাণ করে আশ্রয় নিয়েছে। তবে বনবিভাগের উর্ধতন কেই সে ব্যাপারে কোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা য়ায়নি। একটি সুত্র বলছে, স্থানিয় রাজনৈতিক কয়েকজন নেতা সিন্ডিকেট তৈরী করে প্রতি শেট থেকে ৫০০টাকা করে আদায় করার অভিযোগ উঠেছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বলেন, সীমান্ত জুড়ে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। তাদের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলা পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। যাতে করে কোনও ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সে ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। পুলিশ সেভাবেই কাজ করছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক আলী হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো কোনমতেই সম্ভব হচ্ছেনা। তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। আমাদের পক্ষ থেকে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের প্রতিরোধ করতে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি জানতে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হচ্ছে।’

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশ সদস্য বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়। এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযানের নামে সাধারণ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ,বাড়িঘরে আগুনসহ নানা নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। এ কারণে প্রতিদিন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছে অসংখ্য রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘের তথ্যমতে,এ পর্যন্ত ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এছাড়াও নাফ নদীর জলসীমানা থেকে শুরু করে স্থল সীমানা পার হয়ে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর একই ধরনের ঘটনা ঘটে। এসময় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। তবে তারা এর তোয়াক্কা না করে আরকানে ফের সেনা মোতায়েন করলে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়িয়ে পড়ে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।

পাঠকের মতামত: