ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাদেশ থেকে দেখা যাচ্ছে মিয়ানমার জ্বলছে

তেজস্রী থাপা  ::

আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বাংলাদেশ সীমান্তে নাফ নদীর তীরে। দেখছিলাম মিয়ানমারে একটি গ্রাম থেকে আকাশে উঠে যাচ্ছে ভারি ধোয়া। বাংলাদেমের সীমান্ত রক্ষীরা বলেছেন, সীমান্তের কাছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামগুলোকে টার্গেট করে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা এ পর্যন্ত পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন এবং আমি যাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছি তাদের চোখেমুখে দেখতে পেয়েছি আতঙ্ক। তাদের চোখমুখ ফ্যাকাশে। বাস্তবে প্রতিটি সীমান্ত ক্রসিংয়ে শত শত শরণার্থী আসছেনই। নাফ নদী দিয়ে অনেকগুলো ক্রসিং আছে। এমন একটি মাত্র ক্রসিংয়ে আমি মাত্র ২০ মিনিট ছিলাম। এরই মধ্যে আমি দেখতে পেয়েছি কয়েক শত মানুষ প্রবেশ করেছেন বাংলাদেশে। এর মধ্যে রয়েছেন শিশু সহ মা থেকে শুরু করে বয়স্ক ও জরাগ্রস্তরা পর্যন্ত। একজন যুবকের আশঙ্কা আরো সহিংস দমনপীড়ন চালানো হবে। তার ভাষায়, এখন রাখাইনে আমাদের যা বাকি আছে তা হলো শূণ্য গ্রাম। সেখানে কোনো পুরুষ নেই। কোনো মানুষ নেই। আগে আমরা নারী ও শিশুদের সরিয়ে দিয়েছি। এখন আমাদেরকেও সরে যেতে হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াট নতুন বেশ কিছু স্যাটেলাইট ডাটা পেয়েছে। তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক হারে অগ্নিকান্ডে পুড়ে যাওয়া বাড়িঘর।
আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা, যারা বাংলাদেশে পৌঁছেছেন, তারা বলছেন, গ্রামের পর গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জাতিগত রাখাইনরা। তারা দাঙ্গা সৃষ্টি করছে। পুড়িয়ে দিচ্ছে বাড়িঘর। বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোগিতে ভর্তি হাসপাতালে আমি অনেককে দেখেছি বুলেট ও গোলার আঘাতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের হিসাবে কমপক্ষে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ২৫ শে আগস্ট নতুন করে সহিংসতা শুরুর পরে। ওইদিন আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মির সদস্যরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৩০টি পোস্টে হামলা চালায়। সরকার বলছে, ওই হামলায় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ১১ জন নিহত হয়েছেন। ৭৮ জন নিহত হয়েছে হামলাকারী। এর প্রতিশোধ নিতে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শুরু করেছে। তবে রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ওই ঘটনার পর সরকারের অভিযানে শত শত গ্রামবাসীকে হত্যা করা হচ্ছে। তবে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মি ও রোহিঙ্গাদের দায়ী করছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু তারা এ অভিযোগের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি। ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ডিসেম্বরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের গ্রাম এভাবে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখনও সরকার একই রকম অভিযোগ করে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অন্যরা নিশ্চিত হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ওইসব গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গারা পৌঁছেই কোনো মতে মাথা গোঁজার স্থান খুঁজেছেÑ কখনো রাস্তার পাশে। কখনো পাহাড়ের ঢালে। কখনো বাজারের পাশে বা শহরের পাশে। পালিয়ে আসতে পেরে তারা খুশি। কিন্তু মিয়ানমারে পরিবারের যেসব সদস্যদের রেখে এসেছেন তাদের নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। ওদিকে মানবিক সহায়তার ভান্ডার ফুরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ত্রাণ কর্মীরা বলছেন, তাদের কাছে যে পরিমাণ উচ্চ শক্তিযুক্ত বিস্কুট আছে তা দিয়ে নতুন আগত রোহিঙ্গাদের চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। কয়েক হাজার শিশুর জন্য প্রয়োজন স্কুল। তাদের আরো প্রয়োজন টীকা। আসলে রোহিঙ্গারা যে ট্রাজেডির মুখোমুখি তা বহুমুখি। এক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ।

তেজস্রী থাপা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র গবেষক।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ
)

পাঠকের মতামত: