ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলিতে বাংলাদেশীদের মধ্যেও আতঙ্ক

bondukjoddকক্সবাজার প্রতিনিধি ::

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর থেকে সেখানকার সেনা অভিযানের অব্যাহত দমন-নিপীড়নের মুখে দলে দলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চেষ্টা এবং মিয়ানমার অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত গোলাগুলির ঘটনায় আতংক বিরাজ করছে সীমান্তবর্তী এলাকার বাংলাদেশিদের।
একই সঙ্গে মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টর মহড়া ও মিয়ানমারের গোলা বারুদ বাংলাদেশ প্রবেশ আতংক বাড়িয়ে দিয়েছে।
সোমবার সকালে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর ৪০ সদস্যের একটি দল ঘুমধুম সীমান্তের কাটা তারের বেড়া হয়ে তুমব্রু দিকে মহড়া দেন। এ সময় গুলিও বর্ষণ করেন বলে নিশ্চিত করেন তুমব্রু উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুল হক।
তিনি জানান, এসময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতংক তৈরী হওয়ায় স্কুল ছুটি দেয়া হয়। এর কিছুক্ষণ পর একবার হেলিকপ্টার মহড়া দেখা যায়। রোববারও দুই বার মিয়ানমারের আকাশে হেলিকপ্টার দেখা যায়।
শনিবার বিকালে সীমান্তে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী এলাকায় অনুপ্রবেশ চেষ্টার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়নমারের ঢেঁকিবুনিয়া এলাকার দিক থেকে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর ছোঁড়া গুলি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থানীয় বাসিন্দাদের ২ টি বসতবাড়ীতে এসে লাগায় স্থানীয় লোকজনের মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
এছাড়া সীমান্তবর্তী মিয়ানমার অভ্যন্তরে প্রতিদিনই থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আরো বেড়েই চলছে। সরেজমিন উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
আর আতংকিত হওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজনও।
তবে রোববার উখিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতি পরিদর্শনে এসে প্রেস ব্রিফিংকালে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলিবর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন।
এতে বিজিবিসহ বিভিন্ন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর কঠোর নজরদারী সত্বেও প্রতিদিনই টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঘটছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা। রোববার মধ্যরাত থেকে সোমবার ভোর রাত পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টকালে ১২৪ জন রোহিঙ্গা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও পুলিশ। এসময় অনুপ্রবেশে সহায়তার অভিযোগে উখিয়া থানা পুলিশ এক রোহিঙ্গাসহ ২ দালালকে আটক করেছে।
অন্যদিকে সোমবারও উখিয়ার ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের শূণ্যরেখার খুব কাছাকাছি কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় অবস্থান নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা।
ধামনখালী এলাকার কলেজ শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম বলেন, সোমবার দুপুর আড়াই-টা পর্যন্ত ধামনখালী, রহমতের বিল ও আঞ্জুমান পাড়াসহ আশপাশে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। তারা অপেক্ষায় আছেন সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য।
রোববার কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকার সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে কথা হয় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য গফুর উদ্দিন বলেন, গত বৃহস্পতিবার থেকে মিয়ানমারে সহিংসতার পর প্রতিদিনই থেমে থেমে গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। এতে আতংকগ্রস্ত হাজার হাজার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হচ্ছে। সীমান্তের খুবই কাছাকাছি গোলাগুলির ঘটনা ঘটায় স্থানীয়রা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে।
“ দিনের এমন কোন সময় নির্ধারণ নেই ; গোলাগুলির ঘটনা ঘটতে পারে। হঠাৎ করে দিন-রাতের যে কোন সময় শুরু হয়ে যায় থেমে গোলাগুলির ঘটনা। তবে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং ভোর রাতের দিকেই বিশেষত ঘটনাগুলো ঘটছে বেশী। ”
শনিবার বিকালে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়ার দিক থেকে ছোঁড়া গুলি সীমান্তবর্তী ধামনখালী এলাকার ২ বসতবাড়ীতে এসে পড়ার পাশাপাশি প্রতিদিনই গোলাগুলির অব্যাহত থাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে জানান পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী মো. আব্দুল মান্নান।
এ ঘটনায় পালংখালী ইউনিয়নের ধামনখালী এলাকার মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে ছৈয়দুল হকের (৭০) বাড়ীর মাটির তৈরী দেয়ালে এবং স্থানীয় আরেক বাসিন্দা আবুল হোসেনের বাড়ী চালের টিনে গুলি লাগার ঘটনা ঘটেছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “ এ ঘটনার পর থেকে সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। পাশাপাশি স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবিরাও কাজ করছেন আতংক নিয়ে। এতে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে স্থানীয়দের মাঝে। ”
তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি বলে জানান কক্সবাজার আইনজীবী সমিতির সদস্য মান্নান।
এদিকে রোববার বসতবাড়ীতে গুলি লাগার ঘটনার দ্বিতীয়দিন ধামনখালী সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত স্থানীয় বাসিন্দা ছৈয়দুল হকের বাড়ীতে গিয়ে দেখা মেলে, বাড়ীটির বারান্দার মাটির তৈরীর দেয়ালের ভিতরের দেয়ালের কাছাকাছি ৪ টি স্থানে নতুন করে লেপন করে দেয়ার চিহ্ন।
গৃহকর্তা ছৈয়দুল হকের ছেলে ফিরোজ মিয়া (৪৫) দাবি করেন, “ এসব চিহ্ন গত শনিবার বিকালে ধামনখালী সীমান্তের ওপাড়ে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়ার দিক থেকে ছোঁড়া গুলি লাগার। গুলিগুলো দেয়াল ভেদ করে বের হতে পারেনি। গুলি লাগার কারণে সামান্য মাটি খসে পড়া দেয়ালের ৪ টি স্থানে নতুন করে লেপন করা হয়েছে। ”
গুলিগুলো এখনো দেয়ালের ভিতরে রয়েছে বলে দাবিও করেন তিনি।
ফিরোজ মিয়ার স্ত্রী পারভীন আক্তার বলেন, ঘটনার দিন বিকালে বাড়ী ভিতরে পরিবারের অন্যদের নিয়ে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখছিলাম। হঠাৎ করে শুনতে পাই মুহুর্মুহু শোঁ-শোঁ শব্দ।
“ পরে বাড়ীর ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই, বাইরে বাড়ীর ভিটের বাগানের গাছগুলোতে বৃষ্টির মতো করে কিছু একটা ছুঁড়ে এসে পড়ছে। এভাবে থেমে থেমে দু‘য়েক মিনিট চলার পর এক পর্যায়ে বন্ধ হয়। ”
তিনি বলেন, “ শোঁ-শোঁ শব্দ বন্ধ হলেও বাইরে এসে দেখতে পাই বাড়ীর বারান্দার ভিতরের দেয়ালের ৪ টি স্থানে কাছাকাছি গুলির আঘাত লেগে মাটি খসে পড়ার চিহ্ন। ”
গুলি লাগার ঘটনার সময় বাড়ীতে থাকা পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে টিভির অনুষ্ঠান দেখতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বলে মন্তব্য করেন পারভীন।
তবে সীমান্তে মিয়ানমারের ওপাড়ে প্রতিদিনই গুলিবর্ষণ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটার সত্যতা স্বীকার করলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলি এসে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল মঞ্জুরুল হাসান খান।
তিনি বলেন, “ সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে অনুপ্রবেশ চেষ্টার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়ানমার দিক থেকে ইতিপূর্বে কয়েকবার গুলিবর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে। তবে গুলিগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়েনি। ”
এছাড়া মিয়ানমার দিক থেকে ছোঁড়া গুলি বাংলাদেশের ২ নাগরিকের বাড়ীতে আঘাত লাগার বিষয়টি শুনেননি বলে জানান লে. কর্ণেল মঞ্জুরুল।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবির সীমান্তে কড়া অবস্থানে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কোন কারণ নেই। বিজিবি টহল জোরদার করার পাশাপাশি অতিরিক্ত ফোর্স বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া যে কোন ধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবির সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছে। ”

পাঠকের মতামত: