ঢাকা,শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

চকরিয়া পৌর শহর রক্ষা বাঁধে বড় ধরনের ফাটল ।। আতঙ্কে মাতামুহুরী তীরের বাসিন্দারা বসতবাড়ি খুলে সরিয়ে নিচ্ছেন মালামাল

20031644_1963641670559173_3416718549327522226_n19959445_500937863583027_6174162700855232145_nছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :::

কক্সবাজারের চকরিয়া পৌর শহর রক্ষা বাঁধ তথা এক নম্বর গাইড বাঁধে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বাঁধের বিশাল অংশ নদীতে তলিয়ে গেছে। এই অবস্থায় নদী তীর ও আশপাশের কয়েকশ পরিবারের মাঝে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অনেক পরিবারকে বসতবাড়ি খুলে আসবাব পত্রসহ প্রয়োজনীয় মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে।

অভিযোগ উঠেছে, এবারের ভয়াবহ বন্যায় এই বাঁধের যে স্থানে বেশি ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত শনিবার থেকে জরুরি কাজ শুরু করেছে। এ কাজ করতে গিয়ে বিলিন হতে থাকা অংশে ভাঙন ঠেকাতে কয়েকশ বড় বড় সাইজের গাছ পোঁতা হয়। কিন্তু এসব গাছ পোঁতার কারণে তলদেশের মাটি আরো হালকা হয়ে গতকাল সকালে বাঁধের পৌরসভার দিগরপানখালী পয়েন্টে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়। এরপর সকাল থেকে গাছ পোঁতা বন্ধ রেখে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করে। এভাবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে বড় ধরনের ফাটল ধরা এই গাইড বাঁধ কিভাবে রক্ষা হবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, যে কোনোভাবে এই ভয়াবহ ভাঙন ঠেকানো হবে। এজন্য বালুভর্তি প্রয়োজনীয় জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু পাউবো কর্মকর্তাদের এমন আশ্বাস আস্থায় নিতে না পারায় আশপাশের অসংখ্য পরিবার তাদের বসতবাড়ি খুলে আসবাবপত্রসহ মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। বাঁধের এই দূরবস্থার কারণে অনেক পরিবারে কান্নার রোল পড়েছে।

সম্প্রতি এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেওয়ায় দুবাই থেকে বাড়িতে চলে আসেন পশ্চিম দিগরপানখালীর প্রবাসী মোহাম্মদ ইয়াছিন। গতকাল কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যার সময় পৌর শহর রক্ষা বাঁধটির দূরবস্থা দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা এটি পরিদর্শন করেন। এর দুদিন পর বিলিন হতে থাকা বাঁধে বড় বড় গাছ (স্থানীয় ভাষায় বল্লি) পোঁতা শুরু হয়। কিন্তু এসব গাছ পোঁতার কারণে নদীর তলদেশের মাটি আরো হালকা হয়ে পড়লে আজ (গতকাল) সকালে বড় ধরনের ফাটল দেখা দেয়।’

প্রবাসী ইয়াছিনের সাথে সহমত পোষণ করেন স্থানীয় মিজানুর রহমানসহ অনেকে। তারা বলছেন, ‘যদি গাছ না পুঁতে প্রথমদিন থেকেই বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হতো তাহলে বাঁধটির এই বিপর্যয় দেখা দিত না। অপরিকল্পিতভাবে এই ভাঙন ঠেকাতে গিয়ে বাঁধটি এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে। তাছাড়া বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এই বাঁধের ভাঙন আরো তীব্র হয়েছে। এ কারণে আশপাশের পরিবারগুলো তাদের বসতবাড়ি খুলে আসবাব পত্রসহ প্রয়োজনীয় মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে।’

ফাটল ধরা বাঁধের পাশের বসতবাড়ির মালিক নুরুল কবির ও নুরুল আবচার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আজ (গতকাল) সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি বাঁধে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। এই দৃশ্য দেখে পরিবারে কান্নার রোল পড়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে বসতবাড়ি খুলে আসবাব পত্রসহ প্রয়োজনীয় মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছি।’ আতঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড যেভাবে পরিকল্পনা করে পৌর শহর রক্ষা বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে কাজ শুরু করেছে এতে দুশ্চিন্তা আরো বেড়েছে আমাদের। অপরিকল্পিত কাজের কারণে মনে হচ্ছে এই বাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকাও পানিতে চলে যাবে।’ স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘ভাঙনের কবলে পড়ে বসতবাড়ি নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এখনো সেখানে টিউবওয়েল অ ত রয়েছে। বর্তমানে পরিবার সদস্যদের নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি।’

সরেজমিন দেখা যায়, বাঁধ রক্ষার জরুরি কাজটি বাস্তবায়ন করছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। বিলিন হওয়া বাঁধে গাছ পোঁতার কারণে তলদেশের মাটি আরো হালকা হয়েছে এলাকাবাসীর এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘যারা এ ধরনের কথা বলছেন, তাদেরকে আমার সামনে হাজির করেন। কে বলেছে আমি তাদের দেখতে চাই।’ এ সময় তার পাশে থাকা কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান দাবি করেন, ‘গাছ পোঁতার কারণে বাঁধের কোনো সমস্যা হয়নি। নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ায় এই বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। তাই আপাতত গাছ পোঁতা বন্ধ রেখে বালুভর্তি করে জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করেছি।’ এতে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।

চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘এই বাঁধ রক্ষা করা না গেলে পৌরসভার বিশাল অংশ এবং কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিশাল অংশের ওপর দিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পড়তে পারে। এ কারণে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।’

স্থানীয় কয়েকজন প্রবীণ জানিয়েছেন, দেশ স্বাধীনের আগে ভয়াবহ বন্যায় রাতারাতি মাতামুহুরী নদীর বর্তমান গতিপথ বদলে গিয়ে দিগরপানখালী অংশ হয়ে বড় ধরনের শাখা খালের সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে সে সময় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন স্থানীয়রা। ওই সময় চকরিয়া ও পেকুয়ার অন্তত ২০টি ইউনিয়নে সেচ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন কৃষকরা। তখন এ অঞ্চলে খরা দেখা দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরাতন বিমান বন্দরে (বর্তমানে সেনাক্যাম্প) জনসভা করতে আসেন। ওই জনসভায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে তিনি বর্তমান মহাসড়কের ভাঙারমুখ থেকে ঘুনিয়া পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার নদীর তীরে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এতে আগের গতিপথ ফিরে পায় মাতামুহুরী নদী।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরীকে জরুরি কাজ বাস্তবায়নে নিয়োজিত করা হয়েছে। বিলীন হওয়া বাঁধস্থলে গাছ পোঁতার কারণে তলদেশের মাটি আরো হালকা হয়েছে—এলাকাবাসীর এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘যারা এ ধরনের কথা বলছে, তাদের আমার সামনে হাজির করেন। আমি তাদের দেখতে চাই। ’ চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো. আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘এই বাঁধ রক্ষা করা না গেলে পৌরসভা ও কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিশাল অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ’

স্থানীয়রা জানান, ‘এই বাঁধটি মূলত নির্মাণ করা হয় বড় বড় বোল্ডার পাথর দিয়ে। কিন্তু কিছুদিন পর সেই পাথর স্থানীয় দুর্বৃত্তচক্র চুরি করে নিয়ে যায়। এ কারণে বর্তমানে এই বাঁধটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। যদি এই বাঁধ আগের মতো পাথর বা ব্লক ফেলে নির্মাণ করা না হয় তাহলে প্রতিবছর এই সমস্যা দেখা যাবে।’

পৌর শহর রক্ষা বাঁধে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার খবর পেয়ে সকালে ঘটনাস্থলে যান চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাঁধটি যাতে রক্ষা করা যায় সেজন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা জরুরি কাজের অংশ হিসেবে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছেন।’

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বলেন, ‘এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, আপাতত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলে এই বাঁধটি রক্ষায় কাজ করা হচ্ছে। বর্ষাকাল চলে গেলে বাঁধটি টেকসইভাবে নির্মাণ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থবরাদ্দ চাওয়া হবে। তাই কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।’

পাঠকের মতামত: