ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

মরণ নেশার ইয়াবার বিষাক্ত ছোঁবলে সাগর দ্বীপ কুতুবদিয়া

yabaaমুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, কুতুবদিয়া থেকে ফিরে ::

 কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার তরুণ-তরুণীরা এখন আসক্ত হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবায়। স্থানীয় ভাষায় এ মাদক ‘বাবা’, ‘ছোটমাথা’, ‘বড়মাথা’ ও ‘গুটি’ নামে পরিচিত। জেলার সীমান্ত শহর টেকনাফ হয়ে জল ও স্থলপথে দ্বীপ কুতুবদিয়ায় প্রবেশ করছে ছোট-বড় ইয়াবার চালান। পরে পাইকারি বিক্রেতার হাত হয়ে তা যাচ্ছে খুচরা বিক্রেতার কাছে এবং খুচরা বিক্রেতারা দিচ্ছেন ‘হোম সার্ভিস’। ফোন করলেই বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এইসব মাদক। ফলে উপজেলায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িছে। অন্যদিকে মাদকের সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন এলাকার জনপ্রতিনিধি, নামধারী কতিপয় সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা-কর্মী।

 কুতুবদিয়ায় শুধু বাবা নয়, হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মরণনেশা হেরোইন, গাঁজা, বাংলামদ, বিভিন্ন জাতের মিশ্রণে তৈরি ককটেল-১. ককটেল-২, মিকচারসহ নানা ধরনের মাদক। তবে উঠতি বয়সী তরুণ-তরুণীরা এখন বেশি জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবায়। মাদকে আসক্ত হচ্ছেন কিছু পুলিশ সদস্য, মাঝবয়সী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্টানের শিক্ষকরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে অন্য মাদকের পরিবর্তে ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের পরিমাণ উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে। মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা এখন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নেশা। মাদকের নিষ্ঠুর পদাঘাতে কেউ লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ধ্বংস করে সর্বস্বান্ত, কেউবা জড়িয়েছেন ভয়ঙ্কর অপরাধ চক্রে। পরিবার তছনছ হয়ে গেছে কারও কারও।

 সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, কুতুবদিয়ায় মাদকাসক্তের শতকরা ৭৫-৮০ ভাগই এখন ইয়াবাসেবী। পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও সেবন প্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় দ্রুত ইয়াবার বিস্তার ঘটছে। মাদক কারবারিদের এ দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে, এসব প্রতিরোধ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে দ্বীপের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।

 অনুসন্ধানে জানা গেছে, দ্বীপের প্রধান তিন-চার জন মাদক ব্যবসায়ী ইয়াবার বড় চালান সীমান্ত শহর টেকনাফ হতে সমুদ্রপথে সরাসরি উপজেলার সদর ইউনিয়ন বড়ঘোপের স্টীমারঘাট, লেমশীখালী ইউনিয়নের দরবারঘাট, উত্তর ধূরুং ইউনিয়নের ধূরুংঘাট ও আকবরবলী ঘাটসহ বিভিন্ন সামুদ্রিক পয়েন্ট দিয়ে দ্বীপে নিয়ে আসে। তারমধ্যে লেমশীখালী ইউনিয়নে দু’জন, আলী আকবর ডেইলে দু’জন, কৈয়ারবিল এলাকার দুই-তিনজন ও বড়ঘোপে কয়েকজন দ্বীপের ইয়াবা ব্যবসার মূলহোতা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে জনপ্রতিনিধিসহ সংবাদকর্মী নামধারীও কয়েকজন রয়েছেন। পরে তারা খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে সাধারণ মাদকসেবীদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছে এসব মরণনেশা। তাছাড়া দ্বীপ হয়ে সাগরপথসহ বিভিন্ন উপায়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে চলে যাচ্ছে এসব মাদক। অভিযোগ রয়েছে, মাদক ব্যবসায়ীরা স্থানীয় প্রশাসনের আমলা, পুলিশ, এলাকার সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক দলের নেতাদের মাসোহারা দিয়ে মাদকের ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। পুলিশ, র‌্যাব ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবার বড় চালান আসছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে।

 সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, ইয়াবার পাইকারি বিক্রেতা বা সেলসম্যানের ভূমিকায় রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। আবার রাজনীতি না করলেও খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করছেন অর্থের লোভে। প্রভাবশালী পরিবারের সন্তানরা স্কুল বা ইন্টারমিডিয়েট থেকেই ইয়াবা সেবন শুরু করছেন। যার ফলে এসব শিক্ষার্থীরা চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এতে করে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন দ্বীপের সচেতন অভিভাবক মহল। এ ছাড়া বড়ঘোপের মগডেইল এলাকায় ড্যান্ডি দিয়ে মাদক সেবন শুরু করেছেন অনেকে। এখন মাদক সেবনের দিকে একাধিক তরুণীও ঝুঁকছে পড়ছে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে কুতুবদিয়া হাসপাতালের পেছনের পুরাতন ভবন, বড়ঘোপের মগডেইল এলাকার কয়েকটি বাড়ি, কলেজ গেইটের লাশঘর, কুতুবদিয়া আদালত ভবন, উপজেলা গেইট, অমজাখালীর আল আমীন মার্কেট, সমূদ্র বিলাস হোটেল, মুরালিয়ার কয়েকটি বাড়ি, স্টীমার ঘাট কৈবর্ত্য পাড়া, লেমশীখালী ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, দরবার ঘাটের বিশ পরিবার কলোনি, ধুরুং বাজারের পুরাতন খাদ্য গুদাম, কুতুব শরিফ দরবার, দরবার রাস্তার মাথা ধুরুং বাজারের কয়েকটি দোকান ঘর, ধুরুং ঘাট, উত্তর ধুরুং এর কুইলার পাড়া, ইফাদ কিল্লা, আকবর বলির ঘাট এলাকা, কৈয়ারবিল পুরাতন কমিউনিটি সেন্টার ভবন, আইডিয়াল হাইস্কুল এলাকা, আলী আকবর ডেইল শান্তি বাজার এলাকা, পূর্ব আলী আকবর ডেইল ঘাটঘর, তাবালের চর এলাকাগুলো যেন মাদক সেবনের গোপন আস্তানা নামে পরিচিত এবং এসব স্থানে নিয়মিত বসে মাদক সেবনের আসর। আর এসব আসরে গাঁজা সাধারণত ‘শুকনা’, ‘সবজি’ নামে পরিচিত, ইয়াবা বা বাবা দু-তিন প্রকার রয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকায় ছোট মাথা এবং ৫০০ থেকে ৬০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে বড় মাথা। আর মাত্র ২০ টাকায় পাওয়া যায় গাঁজার পুঁটলি। অনেকে গ্রাম হিসেবে কিনে থাকেন। মাঝে মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের অভিযানে এলাকার চিহ্নিত কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও রহস্যজনক কারনে বার বার জামিনে ছাড়া পাচ্ছেন।

 জানা গেছে, প্রতিদিন হাজার হাজার পিস ইয়াবা কেনাবেচা হয় উপজেলার বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে। মাদকের টাকা পরিশোধ হচ্ছে বিভিন্ন মোবাইলে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি ছিন্নমূল বা দরিদ্র পরিবারের শিশু ও স্বামীপরিত্যক্তা নারীদের দিয়ে মাদক বহন ও বিক্রি করানো হচ্ছে।

 উল্লেখ্য যে, গত বছর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সাবেক উপজেলা কর্মকর্তা সালেহীন তানভীর গাজী ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীকে হাতেনাতে ধরে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও পরে তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। কিন্তু বর্তমান ইউএনও এখনো পর্যন্ত মাদক বিরুধী কোন উল্ল্যেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করেননি। তবে তিনি অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান তিনি।

 কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহ-পরিচালক সুমন মন্ডল বলেন, তাদের কোনো অস্ত্রধারী লোকবল নেই। পুলিশের সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে অভিযান পরিচালনা বা গ্রেফতার করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া রয়েছে লোকবলের স্বল্পতা। সমস্যা হলো, মাদকসংক্রান্ত প্রচলিত আইনটি ১৯৯০ সালের। এ আইনের বেশ দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে গ্রেফতারকৃতরা সহজেই জামিন পেয়ে যান। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা। এ সুযোগ নিয়ে উপজেলায় মাদক ব্যবসায়ীরা দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুদের ব্যবহার করছেন। এজন্য বিদ্যমান আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা দরকার। অধিদফতর থেকে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

 কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া মোহাম্মদ মোস্তাফিজ ভুঁইয়া বলেন, মাদকের ব্যাপারে প্রশাসন জিরো টলারেন্সে আছে। অভিযান চালিয়ে প্রায়ই মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ ছাড়া জনসচেতনতা বাড়াতে উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে মাদকবিরোধী সমাবেশ করার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এর ফলে মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীর সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে মনে করেন সচেতন মহল।

পাঠকের মতামত: