ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

‘মাতামুহুরী নদীরে একটু দয়া কর, ভাঙ্গিস না আর বসতভিটা, বাপের বাড়িঘর’

নদীর পাড়ের লোকজনগুলো যেন ব্যাঙ, তাদের সর্দি হয় না!

Photo 04.07.17 (1)এম.আর মাহমুদ :::

ব্যাঙের যেমন সর্দি হয় না, তেমনি মাতামুহুরী নদীতে বর্ষায় যতই পানি হোক না কেন নদীর পাড়ে বসবাসরত বনি আদমগুলোর তেমন কোন সমস্যা হয় না। কারণ নদীর পাড়ে বসবাসরত লোকজনগুলো যেন জাতে ব্যাঙ। mr mahপ্রতি বছর মাতামুহুরী নদীর বন্যার পানির তোড়ে নদীর পাড়সংলগ্ন চকরিয়ার বেশিরভাগ ইউনিয়নের লোকজন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছে হরহামেশা। ১৯৮৭ সালের মহা বন্যার পর থেকে এ উপজেলার বেশিরভাগ মানুষ বাঁনের পানিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসলেও পৈতৃক বাড়িঘর ছেড়ে যেতে পারছে না মায়ার টানে, আবার কেউ পারছে না অভাব অনটনের কারণে। তারপরও অতিষ্ট অসংখ্য জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে পৈতৃক ভিটা ছেড়ে সরকারি বনভূমিতে বসবাস করছে। পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষগুলো নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে হিংস্র বন্যপ্রাণি ও পাহাড় ভাঙ্গনের সাথে তাল মিলিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। নদীর পাড়ে বসবাস করে আসছি দাদার আমল থেকে। কাকারা ইউনিয়নের দক্ষিণ কাকারা গ্রামে মাতামুহুরী নদীর পাড়ে কবে থেকে আমাদের এলাকার লোকজন বসবাস করছে সেই ইতিহাস জানা নেই। তবে এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ মাতামুহুরী নদীতে আশীর্বাদ হিসেবে মনে করেন। কারণ নদীর পানিতে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান, সবজি, ফসল ও ক্ষতিকর তামাক চাষ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এক সময় বেশুমার মানুষ নদীতে নৌকা চালিয়ে ও মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল অনন্তকাল ধরে। কিন্তু এখন শুষ্ক মৌসুমে নদীতে নৌকা আর মাছ ধরার লোকজন তেমন একটা দেখা মিলে না। সারা বছর নদীর পাড়ের লোকজন শান্তিতে বসবাস করলেও এখন আর নেই সুখ আর শান্তি। এক সময় বর্ষাকালে অন্তত ৫/৭ দিন টানা বর্ষণ হলে নদীতে বড় ধরণের বন্যা হতো। বাঁনের পানি নদীর দু’কূল তলিয়ে গেলেও লোকালয়ে পানি প্রবেশ করত না। কিন্তু এখন পাহাড়ী এলাকায় দু’দিন একটানা বর্ষণ হতে না হতেই আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ার সিংহভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। লোকালয় গ্রামীণ রাস্তাঘাট বাঁনের পানিতে একাকার হয়ে যায়। বেশিরভাগ পরিবারের চুলায় হাঁড়ি চড়ে না। উপোস অথবা শুকনো খাবার খেয়ে রজনী কাটাতে হয় হাঁটুসমান কাঁদা ডিঙিয়ে বাড়িতে প্রবেশ ও রাস্তায় চলাচল করতে হয়। এসব দেখার যেন কেউ নেই। প্রতি বছর উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট সংস্কার করা হলেও এসব রাস্তাঘাট বাঁনের পানির সাথে নিমিষের মধ্যেই ভেসে যায়। প্রবীণদের মতে, এ সংকটের মূল কারণ মাতামুহুরী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এক সময় এ নদীর কিছু কিছু অংশে ৬০/৭০ থেকে ১ ‘শ হাত পানি থাকত। যে অংশগুলোতে স্থানীয় ভাষায় ‘কুম’ বলা হত। এখন বর্ষায় এক সপ্তাহ বৃষ্টি না হলে নতুনভাবে চর জেগে উঠে আর শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বালুময় চর ছাড়া কিবা আছে। এসব কি প্রাকৃতিক দূর্যোগ না মানব সৃষ্টি দূর্যোগ? তা বিচার বিশ্লেষণের সময় এখনই। নয়নাভিরাম পাহাড়ে নেই বৃক্ষ। নদী ছাড়া ও পাহাড়ের পাথর বলতে কিছুই আমরা রাখি নাই। সব সাবাড় করে দিয়েছি। ফলে প্রতি বছর পাহাড় ভেঙ্গে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে সামান্য বৃষ্টি হলে ভরাট নদীর পানি লোকালয় তলিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিশাল মাতামুহুরী নদীর পানি বন্যার সময় সমুদ্রের সাথে একাকার হওয়ার জন্য খোদায়িভাবে সৃষ্টি অসংখ্য শাখা নদীর প্রবাহ বন্ধ করে এক শ্রেণির প্রভাবশালী লোকজন মৎস্য চাষ করছে তারা প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আয় করলেও তাদের কারণে নদীর পাড়ের লোকজন সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী শাসনের নামে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও এসব উন্নয়নমূলক কাজ পানিতেই যাচ্ছে। দূর্যোগ শুধু বেড়েই চলছে। কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, পৌরসভা, বরইতলী, হারবাং, বি.এম.চর, কোনাখালী, পূর্ব বড় ভেওলা, শাহারবিল, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী, চিরিংগা, বেশিরভাগ মানুষ বর্ষা মৌসুমে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে আসছে। বর্ষায় চাষিরা চাষাবাদ করলেও যথাসময়ে ফসল গোলায় তুলতে ব্যর্থ হয় বন্যার কারণে। প্রতি বছরই মাতামুহুরী নদীর ড্রেজিংয়ের কথা শোনা গেলেও কাজের সময় কিছুই হয় না। যা অনেকটা ‘রাধা নাচল না, দেড় মণ ঘিও উঠলো না।’ এ অবস্থা। মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে পার্বত্য বান্দরবান জেলার আলীকদম ও লামা উপজেলার বুকচিরে মাতামুহুরী প্রবাহিত হয়ে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন অংশ হয়ে সরপিল গতিতে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। শুধুমাত্র পরিকল্পিতভাবে নদী শাসনের অভাবে নদীর দু’পাড়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে বর্ষায় মাতামুহুরী নদী যেন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এ নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই‘শ কিলোমিটার। শিল্পী মনির খাঁনের গানের সুরে লেখাটির ইতি টানতে যাচ্ছি ‘ও নদীরে একটু দয়া কর, ভাঙ্গিস না আর বসতভিটা, বাপের বাড়িঘর।’ বান্দরবান ও কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড এ নদীর ভাঙ্গণ কবলিত এলাকা রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। প্রতি বছর কোন না কোন অংশের টিকাদারের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু দূর্ভোগ কোনভাবেই কমছে না। যে কারণে বর্ষা আসলেই নদীর পাড়ের লোকজন চরম শংকিত হয়ে বসবাস করে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যেতে পারে না রাক্ষুসে মাতামুহুরী নদীর বন্যার তান্ডবে। শাসকদলের দায়িত্বশীল কিছু নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা বন্যার সময় কেউ কিছু কিছু ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে দেখতে যায়, আবার কেউ যায় আনন্দ ভ্রমণে। এসব কি বাঁনবাসী মানুষের প্রতি নির্মম রসিকতা নয়?

পাঠকের মতামত: