ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

মৃত ব্যক্তিরাও অনুষ্ঠান করছে কক্সবাজার বেতারে!

অনলাইন ডেস্ক ::cox betar
২০১১ সালে ২১ জানুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান রামুর প্রতিভাবান শিল্পী ও সাংবাদিক আবীর বড়ুয়া। কিন্তু চলতি বছরের মে ও জুন মাসে দুই দফা সেই আবীর বড়–য়াই কক্সবাজার বেতারের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করেন!। এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনের জন্য ‘আবীর বড়–য়া ও সংগীরা’নামে গোষ্ঠী ভিত্তিক এই পরিবেশনার জন্য তাঁর নামে ৯ হাজার টাকাসহ দশ হাজার টাকার সম্মানীও অনুমোদনের প্রকৃয়াধীন।
একইভাবে গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠানে আরো অংশ নিয়েছেন প্রয়াত শিল্পী ক্যাছেন (ক্যাছেন রাখাইন),প্রয়াত নাট্যশিল্পী তাহানুল কবির রানা,প্রয়াত শিল্পী ওকেছেন রাখাইন ও ইমং চৌধুরী। এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি কয়েক বছর আগে থেকে লন্ডনে বসবাসরত বেতারের সাবেক অনুষ্ঠান ঘোষক নাজমুল আহাম্মদ মুন্না এবং প্রায় এক বছর আগে থেকে জেলে অন্তরীণ বেতারের শিল্পী মো.সেলিমের নাম। শুধু তাই নয়, মৃত,জীবিত এবং প্রবাসী শিল্পীদের সই নকল করে নামে-বেনামে ভুয়া কন্ট্রাক্ট দেখিয়ে শুধুমাত্র মে-জুন দুই মাসেই প্রায় ১৯ লাখ টাকার ভুয়া বিল করেছেন কক্সবাজার বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমানের সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত অন্যান্য বিলের সাথে ১২টি ভাউচারে করা এসব বিল অনুমোদনের জন্য কক্সবাজার জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে পাঠানো হয়েছে। বেতারের নানা অনিয়মের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে এবার বেরিয়ে এলো এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
বেতারের মতো প্রতিষ্ঠানে শিল্পীদের সম্মানীর টাকা নিয়ে এমন জগন্য অনিয়মের জন্য চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন কক্সবাজার বেতারের বিভিন্ন বিভাগের শিল্পীরা। এ ঘটনায় কঠোর আন্দোলনের দিকে যাচ্ছেন শিল্পীরা।
তালিকায় দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন মাসে ৫টি পৃথক বিলে ২৯০ জন শিল্পীর নামে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ২৫ টাকা এবং মে মাসে ৭টি বিলে ৪২২জন শিল্পীর নামে ৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭৫ টাকাসহ মোট ১৯লাখ ৫৫ হাজার ৬০০টাকা বিল করেন। এরমধ্যে এ দুই মাসে ১০৭টি গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে। গোষ্ঠী ভিত্তিক এ সব অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে সবোর্চ্চ ৯ হাজার সর্বনি¤œ ৩ হাজার ২০০ টাকা বিল করা হয়। সে হিসাবে দুইমাসের বিলের সিংগভাগই গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠানের বিল। শিল্পীদের অভিযোগ,মাত্র হাতেগুনা কয়েকটি অনুষ্ঠানছাড়া কোন অনুষ্ঠানই এ দুইমাসে রেকডিং হয়নি। সেখানে ১০৭টি দলগত পরিবেশনা। বিষয়টি অবাস্তব এবং বিষ্ময়কর ও বটে।
মে মাসের ১৩৭ নম্বর বিলের ৬০ জনের তালিকার ৫২ নম্বর ক্রমিকে আছেন প্রয়াত মেধাবী নাট্যকর্মী তাহানুল কবির রানার নাম। যদিও তাঁর শুদ্ধ নাম ছিল তাহানুল বশির রানা। রানা ককসবাজার থিয়েটারে কাজ করতেন রানা ২০১১ সালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। একই মাসের ১৩১ নম্বর বিলের ৭ নম্বর ক্রমিকে আছেন বেতারের শিল্পী মো. সেলিম। সেলিম প্রায় ১ বছর আগে থেকে একটি মামলায় জেলে আছেন। এ তালিকায় ১৯ নম্বরে আছেন শিল্পী ওকেছেনের নাম। ১৩৩ নম্বর বিলের ৯ ও ৫৪ নম্বরে আছেন কক্সবাজার বেতারের সাবেক অনুষ্ঠান ঘোষক নাজমুল আহাম্মদ মুন্না। তিনি প্রায় ৪ বছর ধরে আছেন প্রথমে লন্ডনে। এ তালিকার ১৪ নম্বরে ইমং চৌধুরী এবং ৫৮ নম্বর ক্রমিকে আছেন প্রয়াত শিল্পী সাংবাদিক আবীর বড়–য়ার নাম। ইমং ২০১৫ সালে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের রাখাইনদের বর্ষা উৎসব চলাকালে সাগরে ডুবে মারা যান। আর আবীর বড়–য়া মারা যান ২০১২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। জুনের ১৫০ নম্বর বিলে ৬০ নম্বর ক্রমিকে আছেন কক্সবাজারের সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেনের নাম। অথচ প্রায় ৬ মাস আগে এ কর্মকর্তা অন্যত্র বদলী হন।
এছাড়া কক্সবাজারের পরিচিত শিল্পীদের মধ্যে বেতারের নাট্য প্রযোজক স্বপন ভট্টাচার্য্য,তাঁর স্ত্রী সংগীত শিল্পী বনাণী চক্রবর্তী, শাহ আলম (আলম শাহ),ইমা বড়–য়া,মৈত্রী বড়–য়া, আতাহার ইকবাল, মানসী বড়–য়া,আবু মোর্শেদ চৌধুরী, অনুষ্ঠান ঘোষক আবুল মনজুর,শহিদুল ইসলাম,জয়নাল আবেদীন ও তাপস বড়–য়া, সংগীত শিল্পী আল্পনা দাশ,নাট্যশিল্পী শাহানা মজুমদার,সুবর্ণা হক রূপা,শাহাজাদী ইয়াসমিন,জয়শ্রী বড়–য়া,শামীম আকতারসহ পরিচিতদের মধ্যে শতাধিক শিল্পীর নাম থাকলেও তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিভিন্ন সময়ে তারা অনুষ্ঠান করে থাকলেও এসব অনুষ্ঠান করেননি। এদের মধ্যে আবুল মনজুর,আল্পনা দাশ,ইমা বড়–য়া,মৈত্রী বড়–য়াসহ অন্তত ২০ জন আছে তারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারেই বাইরে আছেন।
তালিকা মতে,একক অনুষ্ঠানছাড়া শুধুমাত্র মে মাসে ৭৫টি ও জুন মাসে ৩২টি গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে। এ সব অনুষ্ঠানের প্রতিটিতে সবোর্চ্চ ৯ হাজার সর্বনি¤œ ৩ হাজার ২০০ টাকা বিল করা হয়। সে হিসাবে শুধুমাত্র গৌষ্ঠীভিত্তিক অনুুষ্ঠানেই ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা।
জুন মাসের ১৪৪ নম্বর বিলের ৬১ জনের তালিকার মধ্যে গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি হচ্ছে গোষ্ঠীভিত্তিক অনুষ্ঠান। এরা হলেন আবুল মনজুর ও সংগীরা ৯ হাজার,মো.শহিদুল ইসলাম ও সংগীরা ৯ হাজার,আয়োয়ার আজাদ ও সংগীরা ৫ হাজার ৫০০ টাকা,ফারজানা ইয়াছমিন ও সংগীরা ৩ হাজার ২০০ টাকা,আমানুল হক ও সয়গীরা ৩ হাজার ২০০ টাকা,সুফিয়া ফেরদেীস ও সঙগীরা ৯ হাজার টাকা,নেজাম উদ্দিন ও সংগীরা ৯ হাজার টাকা,শফি উল্লাহ ও সংগীরা ৯ হাজার টাকা,শাহীন মাহমুদ ও সংগীরা ৩ হাজার ২০০ টাকা, আফসানা আকতার ও সংগীরা ৩ হাজার ২০০ টাকা,আরেফা আকতার ও সংগীরা ৫ হাজার ৫০০ টাকা, মো. ইসমাইল হোসেন ও সংগীরা ৯ হাজার টাকা মহি উদ্দিন ও সঙগীরা ৯ হাজার টাকা,ক্যাছেন রাখাইন ও সংগীরা ৯ হাজার টাকা, মুফিদুল আলম ও সংগীরা ৯ হাজার টাকা ও মো. নায়েব ও সংগীদের নামে ৯ হাজার টাকা বিল দেখানো হলেও এদের মধ্যে প্রথম দুজন ও মৃত ক্যাছেনছাড়া এসব নামে কোন ব্যক্তিকে খোঁজে পাওয়া যায়নি।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে আবুল মনজুর বলেন ভাই চাকুরীর সুবাদে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের বাইরে অবস্থান করছি। যে কারণে বেতারেই যাওয়া হচ্ছেনা কয়েক বছর,অনুষ্ঠান কিভাবে করি।
শহিদুল ইসলাম বলেন,অনুষ্ঠান ঘোষনার জন্য বেতারে নিয়মিত যাই কিন্তু গত ছয় মাসের কোন কোন গোষ্ঠী ভিত্তিক তো দূরের কথা কোন একক অনুষ্ঠানও করেছি বলে আমার মনে পড়ছেনা। আমার নামে করে থাকলে এটা ভুয়া বিল। আমার সই নকল করে করা হয়েছে।
এ প্রসংগে কক্সবাজার থিয়েটারের নাট্যকার ও নাট্য নির্দেশক এবং বেতারের নাট্য প্রযোজক স্বপন ভট্টাচার্য্য বলেন, কক্সবাজারে সাংস্কৃতিক সংগঠনই আছে হাতেগুনা ১০ থেকে ১৫টি । কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে বেতারে দুই মাসেই ১০৭টি গোষ্ঠী ভিত্তিক অনুষ্ঠান হয়েছে। আর যাদের নামে এ অনুষ্ঠান দেখানো হয়েছে এসব নামের অস্থিত্বই কক্সবাজারে নেই। এটি বড় ধরনের জালিয়াতি। শিল্পীদের সম্মানী নিয়ে এ তো পুকুর চুরি নয়,বলতে হবে সাগর চুরি। তিনি আরো বলেন, শুধূ অর্থ লোপাটের বিষয় নয়,তাঁর নামে আমরা আরো নানা সমস্যার কথা শুনছি। সময় হলে এসবও আপনাদের বলবো।
মৃত ব্যক্তির নামে বিল বিষয়টি শুনে বিষ্ময় প্রকাশ করেন প্রয়াত আবীর বড়–য়ার বড় ভাই বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী প্রবীর বড়–য়া। তিনি বলেন, হাইরে বাংলাদেশ,মরেও শান্তি নাই। বেতারের মতো প্রতিষ্ঠানে এ রকম জগন্য কাজ হয়ে থাকলে এটি খুবই দুঃখ জনক।
কক্সবাজার শব্দায়ন আবৃত্তি একাডেমীর পরিচালক ও বেতারের নাট্য প্রযোজক জসীম উদ্দিন বকুল বলেন, এই আরডির অনিয়ম অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এই অনিয়ম কোনভাবেই সহ্য করা হবেনা। আমরা ইতিমধ্যে আরডি এবং তাঁর একান্ত সহকারী মোসলেমকে অবিলম্বে অপসারণ পূর্বক তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদী সমাবেশের ডাক দিয়েছি। শিল্পীদের দাবি পূরণ না হলে প্রয়োজনে আরো কঠোর আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে।
বেতারের নাট্য শিল্পী পরেশ দে জানান,কক্সবাজার ছোট্ট একটি শহর। সাংস্কৃতিক অংগনের সবাই সবাইকে চেনেন। যাদের নামে ভুয়া কন্ট্রাক্ট দেখানো হয়েছে,কয়েকজন ছাড়া এসব নামে কোন শিল্পী,সংস্কৃতি কর্মী বা সাংস্কৃতিক সংগঠক কক্সবাজারে নেই। জীবিতদের বাদ দিলাম মৃত ব্যক্তির নামে ভুয়া কন্ট্রাক্ট এটা তো বিষ্ময়কর
কক্সবাজার বেতারের নাম প্রকাশে অনিশ্চুক কয়েকজন শিল্পী জানান, দেড় বছর আগে বর্তমান আঞ্চলিক পরিচালক মো. হাবিবুর রহমান যোগদানের পর থেকে বিশেষ দিবসের কয়েকটি অনুষ্ঠানছাড়া সব রেকডিং এক প্রকার বন্ধ করে দেন। শুধু মাত্র হাতেগুনা কয়েকজন শিল্পী কথককে দিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান ছাড়া বেশির অনুষ্ঠানই পুণপ্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু রেকডিং বন্ধ থাকলেও প্রতিমাসে নামে বেনামে লাখ লাখ টাকার ভুয়া বিল দেখিয়ে শিল্পীদের সম্মানী খাতে এসব টাকা আত্মসাৎ করছেন হাবিবুর রহমান।
শিল্পীদের অভিযোগ,এ কাজের প্রধান সহযোগি তার একান্ত সহকারী মোসলে উদ্দিন। মূলত তার পদবী সংগীত সংকলক হলেও ২০০৪ সালে এ কেন্দ্রটি চালুর পর থেকে তিনি আঞ্চলিক পরিচালকের একান্ত সহকারী হিসাবে কাজ করছেন। সে সুবাদে সকল অপকর্মের কলাকৌশল তার রপ্ত করা। বেতারে যে কর্মকর্তাই আসুক না কেন,সুবিধা আদায়ের জন্য অপকর্মে লিপ্ত করতে বাধ্য করেন এই মোসলেম। সব অপকর্মেই মোসলেন থাকেন নাড়ের গুরু হিসাবে। কিন্তু বিএনপির সক্রিয় ক্যাডার হলেও দীর্ঘ এক যুগেরওবেশি সময় ধরে মোসলে উদ্দিন একই কর্মস্থলে বহাল তবিয়তে আছেন। তাই কক্সবাজার বেতারকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে এই আরডি এবং মোসলেম উদ্দিনকে অপসারন জরুরী।
কক্সবাজার বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এ সব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন এখনো বিলই পাইনি। আত্মসাতের প্রশ্নই আসেনা।
কক্সবাজার জেলা হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা সুকোমল বড়–য়া বলেন, পত্র পত্রিকায় সংবাদ দেখে আমরা ওই বিল আপত্তি দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু মৃত ব্যক্তির নাম নাম বাদ দিয়ে ওই বিল আবার গত বুধবার (২৮ জুন) জমা দিয়েছে। আবীর বড়–য়া,ক্যাছেন,উক্যছেন,ইমং চৌধুরীসহ যেসব মৃত ব্যক্তির নাম আগে বিলে ছিলো ওইসব নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। কাগজ ঠিক থাকলে আমরা তো বিল আটকে রাখতে পারিনা। বর্তমানে বিলগুলো অনুমোদনের প্রকৃয়াধীন আছে।

কক্সবাজার রিপোর্ট :

পাঠকের মতামত: