ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

পাচার হয়ে যাচ্ছে অপহৃত শিশুরা

paঅনলাইন ডেস্ক :::

রাজধানীর শেরে বাংলা নগর বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশেই ঈদগাহ। বিকেলে সেখানে খেলাধুলা করে শিক্ষার্থীরা। গত ২২ নভেম্বর বিকেলে সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিল ওই বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ ইমন। কখন যে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো বুঝতে পারেনি সে। তড়িঘড়ি করে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে রওনা হয় সে।

ওই সময় সেখানে ছিল শিশু অপহরণকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য। তারা চেতনানাশক মেশানো রুমাল চেপে ধরে ইমনের মুখে। দ্রুত একটি মাইক্রোবাসে তুলে তাকে নিয়ে যায় গাজীপুরে, তাদের আস্তানায়। পরে তারা মোবাইল ফোনে তার বাবাকে বলে, সন্তানকে ছাড়িয়ে নিতে হলে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আর এ কথা র‌্যাব-পুলিশকে জানানো যাবে না। জানালে তাঁর ছেলেকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়।

ইমনের বাবা তাদের বলেন, ‘আমি দরিদ্র মানুষ, এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নাই আমার। আমার সোনা মানিকরে ফিরায়া দাও। ’ এ কথা শুনে অপহরণকারীরা ফোন কেটে দেয়, আর ফোন ধরেনি।

সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য ইমনের বাবা থানা-পুলিশের শরণাপন্ন হন। থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এরপর পেরিয়ে যায় প্রায় পাঁচ মাস। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে অপহরণকারীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তারা জানতে পারে, মুক্তিপণের টাকা না দেওয়ায় ইমনকে (১৩) বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়েছে। চক্রের সদস্য টিটু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও একই তথ্য দেয়।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুপাচার, মানবপাচারের ঘটনা বেড়েই চলেছে। অপরাধীরা শিশুদের জিম্মি করে এমন সব ভয়াবহ ঘটনা ঘটাচ্ছে যা অকল্পনীয়। বিষয়টি অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে। তাঁরা মনে করেন, মানুষের অমানবিক, নিষ্ঠুর আচরণের কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এসবের প্রতিরোধের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং মানবপাচার প্রতিরোধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে শিশু অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর প্রতিরোধে প্রশাসনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।

জানা গেছে, মাঝে মধ্যে মানবাধিকার বা অন্য কোনো সংগঠনের উদ্যোগে কিছু শিশুকে ফিরিয়ে আনা গেলেও বেশির ভাগের কোনো হদিস মেলে না। গত এক বছরে ইমনের মতো অন্তত ৩০ শিশুকে অপহরণ করে বিদেশে পাচার করার তথ্য পেয়েছে র‌্যাব-পুলিশ। প্রতিটি ঘটনায় জিডি ও মামলা হয়েছে। অনেক পরিবার জানিয়েছে, লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়েও তাদের শিশুদের তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি; বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সারা দেশে ১২-১৩টি শিশু অপহরণকারী চক্র রয়েছে। তাদের কয়েক শ সদস্য রয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক শিশুপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। সাধারণত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের তারা টার্গেট করে। তারা মনে করে, এসব পরিবারের শিশুদের বিদেশে পাচার করা সহজ।

শিশু অপহরণকারীদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। পোশাক-আশাক, চলাফেরা দেখে সন্দেহ করা কঠিন। প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, শিশুদের পিছু নেয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগিতা করেন।

গত দুই বছরে সারা দেশে শতাধিক শিশু অপহরণের ঘটনায় মামলা ও জিডি হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এসব বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয় না। ফলে অপহৃত শিশুদের উদ্ধারের ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম।

বিদেশে পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ কেন জোরালোভাবে নেওয়া হয় না, এ নিয়ে নানা জনের নানা মত। কেউ বলেন আইনি জটিলতার কথা, কেউ বলেন সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ ও ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয়ের অভাব। তবে সবাই বলেন, সবার আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের তত্পর হতে হবে।

উদ্ধার হয় না পাচার হওয়া শিশুরা

গত কয়েক মাসে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে শিশু অপহরণের আরো কিছু ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে বরিশালের তিন শিশু রয়েছে। তারা হলো আলামিন (৮), শুভ (৭) ও ইমন শিকদার (১৩)। অন্য এলাকা থেকে তিন শিশুকে অপহরণের পর পাচার করা হয়েছে। তারা হলো হৃদয় (৮), আনন্দ (৭) ও সুমন (৬)। তাদের নাম জানা গেলেও বাড়ি ও মা-বাবার তথ্য পাওয়া যায়নি। বিদেশে পাচার হওয়া শিশুদের মধ্যে ইমন নামে তিনজন রয়েছে। এক ইমনের বাবার নাম ইকবাল হোসেন, যার কথা শুরুতে বলা হয়েছে; এক ইমনের বাড়ি বরিশাল; আরেক ইমনের গ্রামের নাম জানা যায়নি।

বরিশালের ইমন (ইমন শিকদার) সম্পর্কে জানা গেছে, বরিশাল বিমানবন্দর এলাকার একটি মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত সে, বয়স ১৩ বছর। বাবার নাম বাবুল শিকদার। গত ২০ নভেম্বর ঢাকায় আসার জন্য লঞ্চে উঠেছিল সে।

ইমনের নানা আব্দুল মান্নান খান বলেন, তাকে অপহরণ করা হয় ঢাকার সদরঘাট থেকে। এরপর টিটু নামে অপহরণকারী চক্রের একজন তাঁর কাছে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় তারা প্রথমে ইমনকে হত্যার হুমকি দেয়। পরে বিদেশে পাচার করা হবে বলে জানায়। এখনো ইমনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রতিবন্ধী শিশুও অপহরণকারী চক্রের হাত থেকে রক্ষা পায় না। সানি (৭) নামের বাকপ্রতিবন্ধী এক শিশুর বাবা রাজধানীর মানিকনগরের বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২২ ডিসেম্বর মানিকনগর বালুর মাঠ এলাকা থেকে ওরা (অপহরণকারী) আমার ছেলে সানিকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, আর ফিরিয়ে দেয়নি। ওরা সানির মুক্তিপণ হিসেবে আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছিল। টাকা দিতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু কেন জানি ওরা পরে আর আমাকে ফোন করেনি। পরে জানলাম, ওরা সানিকে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ’

১১ মাস আগে নারায়ণগঞ্জের সানারপাড় থেকে আলম নামে সাত বছরের এক শিশুকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। তাকেও বিদেশে পাচার করেছে তারা। আলমের বাবা নূরে আলম বলেন, ‘আমার ছেলে আলমকে অপহরণ করে চক্রের সদস্যরা মোবাইলে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। আমি বলি, আমি গরিব মানুষ। এত টাকা কোথায় পাব। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেন, আপনাদেরও তো সন্তান আছে। তখন তারা আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। এরপর ফোন কেটে দেয়, আর ফোন দেয়নি। আমি বারবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওদের ওই নম্বর বন্ধ পেয়েছি। সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা আমাকে বলেছে, তারা আলমকে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। ’

বিদেশে পাচার হওয়া আবদুল্লাহর (৮) বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অপহরণকারীরা আমার কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে। এত কইরা কইলাম, আমি গরিব মানুষ। তয় জেহান থাইকা পারি টাহা (টাকা) জোগাড় কইরা দিমু। কিন্তু ওরা আমার সন্তানরে ফিরাইয়া দিল না। ’ তিনি জানান, আট মাস আগে গাজীপুর শহরের কোনাবাড়ি থেকে আবদুল্লাহকে অপহরণ করা হয়। তিনি জানতে পেরেছেন, তাঁর ছেলেকে অপহরণকারীরা বিদেশে পাচার করেছে। এখন তিনি সন্তানের জন্য পুলিশ-র‌্যাবের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

যেভাবে বিদেশে পাচার করা হয়

অপহৃত শিশুদের বিদেশ পাচার করার কাহিনী আরো ভয়ঙ্কর। ইনজেকশন দিয়ে আধমরা করে তাদের বিদেশে পাচার করা হয়। একটি অপহরণকারী চক্রের প্রধান জাকির হোসেন গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে জানায়, বেশির ভাগ শিশুকে তারা রাস্তা বা বাড়ির আঙিনা থেকে অপহরণ করে। মা-বাবা বা পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে একটু দূরে সরলেই সুযোগটি নেওয়া হয়। আগে থেকেই টার্গেট করা হয়। অপহরণের পর চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে বা চেতনানাশক মেশানো রুমাল নাকে চেপে ধরে অজ্ঞান করা হয়। এরপর মাইক্রোবাসে উঠিয়ে আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শিশুর কাছ থেকেই মা-বাবা বা পরিবারের অন্য কারো ফোন নম্বর বা ঠিকানা নেওয়া হয়। একপর্যায়ে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। যারা মুক্তিপণ দিতে ও র‌্যাব-পুলিশকে বিষয়টি না জানাতে রাজি হয় তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। জাকির জানায়, অপহরণ করা বেশির ভাগ শিশুকেই বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়।

জাকির হোসেন জানায়, চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে অপহরণ করা শিশুকে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পাসপোর্ট করার সময় দলের একজন মহিলা সদস্যকে মা সাজানো হয়। বিমানবন্দরে তাদের সহযোগিতা করার লোক রয়েছে। দেশ-বিদেশে তাদের অনেক সদস্য রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও তাদের লোক রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইসহ কয়েকটি দেশের দায়িত্ব পালন করছে তাদের দলের সদস্য শাহাবুদ্দিন ও মনির।

র‌্যাব ১১-এর পরিচালক লে. কর্নেল কামরুল হাসান বলেন, অপহৃত ও বিদেশে পাচার হওয়া অনেক শিশুর নাম জানা গেলেও তাদের গ্রামের বাড়ি অর্থাৎ পরিচয় জানা যায়নি। এই শিশুদের উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘একটি অপহৃত শিশু উদ্ধার হলে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বিষয়টিকে ছোট করে দেখছি না। তবে সারা দেশে অনেক শিশু নিখোঁজ রয়েছে। তাদের বিষয়ে তাদের আত্মীয়স্বজন থানায় জিডিও করেছে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উদ্ধারে তেমন কোনো তত্পরতাও নেই। ওই শিশুদের উদ্ধারের পরিবর্তে তারা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। এ বিষয়টিতে কম গুরুত্ব দেয়। এটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বে অবহেলা ছাড়া আর কিছুই না। ’ তিনি বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলতে হবে, শিশু নিখোঁজের বিষয়ে থানায় করা জিডির ফলাফল কী, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা তিন মাস অন্তর জানাবে থানা। এ ব্যবস্থা করা হলে পুলিশ অবশ্যই তত্পর হবে এবং তারা জবাবদিহির মধ্যে আসবে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অর্গানাইজড ক্রাইম টিমের বিশেষ সুপার (এসএস) মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, যেসব শিশু বিদেশে পাচার হয়েছে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ক বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া শিশুদের উদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ বা ইন্টারপোলের সঙ্গে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। ওই দেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও দেখা দেয়। এসবের জন্য অনেক সময় ব্যয় হয়ে যায়। এই ফাঁকে পাচারকারীরা অবস্থানও বদল করে। আসলে প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, শিশু অপহরণকারী চক্রের অনেক সদস্যকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেক অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। যেসব শিশু উদ্ধার হয়নি তাদের উদ্ধার করতে র‌্যাবের তত্পরতা অব্যাহত আছে।

পাঠকের মতামত: