ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজার সৈকতে হাজার কোটি টাকার খনিজ বালি উত্তোলন অক্ষমতায় নষ্ট হচ্ছে সম্ভাবনা

7f5dfc759a929652429d9740ec8978bb ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার :::

দেশের উপকূলীয় এলাকায় খনিজ পদার্থের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে বেশ আগেই। তবে এসব মূল্যবান পদার্থ উত্তোলনে সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে সামান্যই। এ বিষয়ে বড় ধরনের কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। এদিকে সমুদ্র উপকূলে যেসব স্থানে খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। এর মধ্যে কক্সবাজার উপকূলে ১৭টি বালির স্তূপের মধ্যে ১৫টিই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।

স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮ সালে তত্কালীন পাকিস্তান ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর প্রথমে সৈকতের বালিতে তেজস্ক্রিয় খনিজ পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কক্সবাজারে পাইলট প্লান্ট স্থাপন করে। সৈকত থেকে বালি সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে প্রক্রিয়াজাত শুরু করে। কলাতলীতে স্থাপন করা হয় একটি বালি আহরণ কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকার টেকনাফ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর ও উখিয়ায় মোট ১৭টি বালির স্তূপ আবিষ্কার করেন। এখান থেকে বালি উত্তোলন করে চার টন ভারী খনিজ পৃথক করা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে খনিজ আহরণে এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরমাণুু শক্তি কমিশনের সদস্য (ভৌত বিজ্ঞান) বলেন, পাইলটিং করে বিভিন্ন খনিজ আলাদা করেছি। সেগুলোর নমুনা রয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে কাজ করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। এজন্য অনেক বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন। এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ। তিনি জানান, হুট করে চাইলেই বালি উত্তোলন করা সম্ভব নয়। উপকূলে বালি উত্তোলনে আইনগত বিধিনিষেধ রয়েছে। এজন্য কিছু আইনের সংশোধন প্রয়োজন হবে। বিজ্ঞানীরা জানান, বাংলাদেশে ১৫টি খনিজ পদার্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বর্তমানে রুটাইল, ইলমেনাইট, গারনেট, মোনাজাইট, ম্যাগনেটাইট, জিরকন, কায়ানাইট ও লিউকক্সিন ৮ আহরণ করা সম্ভব। রুটাইল রঞ্জক পদার্থের কাঁচামাল। ওয়েল্ডিং রডের বহিরাবরণ ও টাইটেনিয়াম নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার হয় মোনাজাইট। এটি তেজস্ক্রিয় থোরিয়ামের একটা ফসফেট যৌগ, যার মধ্যে কিছু পরিমাণ সিরিয়াম, ল্যানথানাম ও ইত্রিয়াম থাকে। একই সঙ্গে এটি পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি। এছাড়া পরমাণু বোমার কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয় এটি। ইলমেনাইট উড়োজাহাজ, গাড়ি ও কেমিক্যাল প্লান্টের যন্ত্রাংশ এবং সার্জিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট তৈরিতে ব্যবহার হয়। মোনাজাইট রঙিন টেলিভিশন ও গ্যাস প্লান্টে ব্যবহার হয়। ম্যাগনেটাইট পরমাণু চুল্লি, এক্স-রে মেশিন থেকে বের হওয়া তেজস্ক্রিয় বিকিরণ রোধ করে। জিরকন ইস্পাত কারখানায় তাপ সহনীয় ইক (ব্রিক) হিসেবে ব্যবহার হয়। সিনথেটিক ডায়মন্ড তৈরিতেও ব্যবহার হয় এটি। গারনেটে রয়েছে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং সিলিকা।

এদিকে দীর্ঘ সময় ধরে বাণিজ্যিক উত্তোলনের উদ্যোগ না থাকায় বিভিন্ন স্থাপনার নিচে ঢাকা পড়ছে চিহ্নিত বালির স্তূপগুলো। পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা। ভবিষ্যতে এসব খনিজ উত্তোলনেও তৈরি হচ্ছে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সরেজমিন দেখা যায়, ১৭টি প্রাকৃতিক খনিজ বালির স্তূপের মধ্যে ১৫টি স্তূপই অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী পয়েন্ট থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত খনিজ বালির যে স্তূপটি রয়েছে, বর্তমানে তার ওপর অন্তত ২৫টি সরকারি-বেসরকারি আবাসিক হোটেল, ৫টি রেস্টুরেন্ট, শতাধিক বসতবাড়ি এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরসহ অসংখ্য সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। একইভাবে টেকনাফ বদরমোকাম এলাকায় যে স্তূপটি রয়েছে, তার ওপরও অন্তত ২৫টি বসতিসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সৈকতের লাবণী পয়েন্টে চিহ্নিত স্তূপের ওপর নির্মিত আবাসিক হোটেল কল্লোলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হক বলেন, খনিজ বালির স্তূপ সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। এমনকি হোটেল নির্মাণের সময় কেউ আমাদের তা জানায়নি। সরকারের তরফ থেকেও সতর্ক করা হয়নি। তেল-গ্যাস-জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, উপকূলজুড়ে ছড়িয়ে থাকা খনিজসম্পদ সম্পর্কে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কারোরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। এর আগেও বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে গোপনে চুক্তির চেষ্টা হয়েছে। দেশীয় উদ্যোগে এ সম্পদ উত্তোলনের জন্য প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। অর্থায়ন বাড়াতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রথমেই একটি সামগ্রিক সম্ভাব্যতা যাচাই করা প্রয়োজন। আর পুরো উপকূলের ইকোসিস্টেম নষ্ট হয় এমন অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ এখনই বন্ধ করতে হবে। জানা গেছে, ভারী খনিজ আহরণের অনুমতি চেয়ে গত মার্চে সিঙ্গাপুরভিত্তিক অস্ট্রেলীয় কোম্পানি প্রিমিয়ার মিনারেলস লিমিটেড বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে চিঠি দিয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে খনিজ বালির মজুদ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ হলেও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না বলে জানায় তারা। ২০ বছর মেয়াদি প্রকল্প থেকে করপোরেট ট্যাক্স বাবদ ২০০ কোটি ডলার করপোরেট ট্যাক্স পাওয়ার কথা জানায়। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, খনিজ বালি উত্তোলনের বিষয়ে নতুন করে কিছু জানানো হয়নি। আমাদের কাছে প্রস্তাব এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রয়োজন মনে করলে আইন সংশোধনের বিষয়েও ভাবা হবে।

পাঠকের মতামত: