ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সদর হাসপাতালে রোগী দেখেন কর্মচারী

তুষার তুহিন, কক্সবাজার :
শুক্রবার বিকাল ৪ টা। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে সেবাপ্রার্থীদের লম্বা লাইন। কিন্তু দায়িত্বরত চিকিৎসকের আসন খালি। তবে সামনের চেয়ারে গলায় স্ট্রেথোস্কোপ ঝুলিয়ে একের পর এক রোগী দেখে চলছেন কর্মচারী (মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট) আব্দুল হামিদ। কাউকে ভর্তি লিখছেন, কারো বেলায় ওষুধ লিখে দিয়ে পরে যোগাযোগ করার পর পরামর্শ দিচ্ছেন। দীর্ঘ দেড়ঘন্টারও অধিকসময় এভাবেই সেবা প্রার্থীদের সাথে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করা হয়েছে।
ঘড়ির কাটায় তখনো ৫ টা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। এমন সময় সদর উপজেলার ভারুয়াখালি থেকে কুকুরের কামড়ানো তামিম (৯) কে সদর হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তার বাবা। ওই শিশুকে দেখে ওষুধ লিখে দিয়ে আজ যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেন কর্মচারী আব্দুল হামিদ। এর কিছুক্ষণ পরেই টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে রেফার হওয়া রোগী সাব্বির আহমদ (২৮) আসে চিকিৎসা নিতে। তাকেও দেখলেন হামিদ। ভর্তি লিখে পাঠিয়ে দিলেন সদর হাসপাতালের পঞ্চম তলায়। কিন্তু ঘুর্ণাক্ষরে স্বজনরা বুঝতে পারেননি তার রোগীকে চিকিৎসক নয় স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিয়েছেন। এভাবেই প্রতিনিয়ত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রতারিত হচ্ছে সেবা গ্রহীতারা। আব্দুল হাকিমের সাথে কথা বলে জানা যায়, গতকাল ওই সময়ে জরুরী বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন ডা. ওয়াহিদুরজাম্মান মুরাদ। তবে সেই মুহুর্তে চিকিৎসক কোথায় রয়েছেন তা জানাতে পারেননি তিনি।
তবে পরবর্তীতে ডা. মুরাদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিকাল ৪ টার দিকে তিনি দুপুরের খাবার খেতে গিয়েছিলেন । খাবার খেয়ে এসে একজন নিহতের পোষ্টমর্টেম তৈরি করেছেন। ওইসময় হয়তবা আব্দুল হামিদ কিছু রোগী দেখেছেন বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
ডা. মুরাদ আরো জানান, বৃহস্পতিবার দিনগত রাত থেকে তিনি একটানা ডিউটি করছেন। শুক্রবার রাতেও তার ডিউটি রয়েছে।
তবে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. পূচনু জানান, কোনভাবেই চিকিৎসক ব্যতিত অন্য কেউ রোগী দেখতে পারেন না। এছাড়া রোষ্টার অনুযায়ী দিনে একজনের আট ঘন্টার বেশী কাজ করার সুযোগ নেই।
শুক্রবার দুপুর ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত হাসপাতাল পরিদর্শন করে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থপনার চিত্রের দেখা মিলেছে। জরুরী বিভাগের প্রবেশ গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখা মিলল কলার খোসা সহ ছড়িয়ে ছটিয়ে রয়েছে নানা আবর্জনা। তবে দুর্গন্ধ তেমন নয়। কিন্তু ইনডোরে প্রবেশ মুহুর্তেই এমন দূর্গন্ধ নাকে এসে বিধল যাতে বমি আসার উপক্রম হয়। এসময় রোগী পরিবহনে ব্যবহৃত সিড়ির রেলিং আর্বজনার ভাগাড় দেখা গেছে। মনে হল কয়েকমাস যেন এ জায়গাটি পরিষ্কার করা হয়নি। হাসপাতালের নিচ তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত মেঝেতে ছড়িয়ে রয়েছে আবর্জনা। আর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দুর্গন্ধ।
পরিদর্শনে আরো দেখা যায়, হাসপাতালে ধারন ক্ষমতা ২৫০ হলেও চিকিৎসারত রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন। ওয়ার্ড ভর্তি রোগী আর ময়লার স্তুপ যেন মিলেমিশে একাকার। রোগী ও স্বজনদের চাপে হাটার কোন জায়গা নেই। রোগী রয়েছে মেঝেতে, বারান্দায়, টয়লেটের সামনে। যে যেখানে সম্ভব হয়েছে সেখানেই জায়গা দখল করে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে। তার সাথে রয়েছে রোগীদের সাথে আগত আত্মীয় স্বজন। মেঝের কোথাও কলার চোপড়া, কোথাওবা চিপসের খালি প্যাকেট আবার কোথাও রোগীর বর্জ্য ব্যান্ডেজ আর কাপড়চোপড় পড়ে রয়েছে। এমন স্যাতস্যাতে কুৎসিত পরিবেশ হাসপাতালের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিভাগের দায়িত্বহীনতাকেই মনে করিয়ে দেয়।
শুক্রবার ও শনিবার ইনডোর ভিসিটের জন্য চিকিৎসক রয়েছে। তবে রোগী ওস্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সারাদিন ওয়ার্ড পরিদর্শনে কোন চিকিৎসক যাননি।
স্বাস্থ্যকর্মীর রোগী দেখা, ইনডোর চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, হাসপাতালের যততত্র ময়লা আবর্জনা পড়ে থাকা সহ দুর্গন্ধময় পরিবেশ জানান দিচ্ছে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থপনার কথা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪ দিন যাবৎ সদর হাসপাতালে পুরুষ ওযার্ডে চিকিৎসা রত এক যুবক জানান, নার্স তাকে জানিয়েছেন শুক্রবার ডাক্তার আসেন না।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. বিধান পাল জানান, তার জানামতে ইনডোরে সেবা দেওয়ার জন্য বন্ধের দিনও চিকিৎসক বরাদ্দ রয়েছে।
এবিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. পূচণূ জানান,তিনি হাসপাতালকে পরিষ্কার পর্চ্ছিন্ন ও একটি নিয়মের মধ্যে আনার জন্য জিহাদ ঘোষনা করেছেন। তাই এমন অনিয়ম হয়ে থাকলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হবে।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের গভর্নিং বডি’র সভাপতি সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল জানান, অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে হাসপাতালে মাসিক সভায় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এর আগে তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব অনিয়ম খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, দ্রুত এসব অনিয়ম বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

পাঠকের মতামত: