ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

নারী পাচারে ট্রানজিট বাংলাদেশ বাধ্য করা হয় দেহব্যবসায়, পাচারের নিত্যনতুন কৌশল

পৃথিবীতে মানব পাচারের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশ নারী পাচারের অন্যতম একটি ট্রানজিট পয়েন্ট। দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচার ব্যবসায়ীদের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আর এই দেশ থেকে পাচারকৃত মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই নারী-কিশোরী। নিত্যনতুন কৌশলে তাদের পাচার করা হচ্ছে। কখনো মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর কাজ দেওয়ার কথা বলে, কখনো সাংস্কৃৎতিক কর্মী হিসেবে আবার ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলেও নারী ও কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে। আর পাচারের পর বিদেশে তারা দুর্বিষহ জীবনযাপনের শিকার হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্য, সহজে এবং অল্পসময়ে টাকা উপার্জনের জন্য এক শ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্সির লোক, স্থানীয় আবাসিক হোটেল মালিক ও কর্মচারী, বিদেশি পতিতালয়ের এজেন্ট এবং বস্তির মাস্তানরা এই পাচারের সঙ্গে জড়িত। জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদন মতে, পাচারকৃত কন্যা শিশু ও কিশোরীদের মধ্যে ৯০ শতাংশকেই জোরপূর্বক দেহব্যবসা করানো হচ্ছে। আর দেশের মোট পাচারের ১৩.৮ শতাংশই নারী-কিশোরী কলকতার পতিতালয়ে আছে। ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে প্রতিবছর প্রায় চার হাজার মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। যার মধ্যে নারী ও মেয়ে শিশু ৪০০। গত এক দশকে ১২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে তিন লাখ নারী ও শিশু পাচার হয়। আর জাতীয় মহিলা পরিষদের হিসাব মতে, ২০১৬ সালে ৫৮ জন নারী পাচার হন এবং ১২৮ জন নিখোঁজ হন।

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের ২০১৬ সালের মানবপাচার প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের সীমান্তের পুলিশ, রাজনীতিবিদ ও সীমান্তরক্ষা বাহিনী পাচার কাজ পরিচালনার জন্য একটি টোকেন ব্যবহার করে। যার মাধ্যমে পাচারকারীরা পালিয়ে যেতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে মানবপাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যদিও আগের চেয়ে পাচার সংক্রান্ত অনুসন্ধান কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য সরকার ২০১৫-১৭ সালের জন্য জাতীয় পরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছে। আর ভিকটিমদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ড্রপ-ইন সেন্টার ও সেফ হোম তৈরিতে অর্থায়ন করছে। কিন্তু দেশে ফিরিয়ে আনার পর ভিকটিমদের তেমন সহযোগিতা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না। উদ্বেগের বিষয় এই যে,      বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সাংস্কৃতিক দলের মধ্য দিয়ে কর্মী হিসেবে এবং পর্যটন ভিসায় ভ্রমণের মাধ্যমেও নারী পাচার হচ্ছে বলে কিছুদিন আগে সংসদীয় কমিটি অভিযোগ করে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এই অভিযোগ উঠে। মালয়েশিয়া, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক টিম ও ভিজিট ভিসায় নারীদের নিয়ে কয়েকটি পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচার হওয়া নারীরা পরে সেখানকার মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলে বিষয়টি সামনে আসে। সাধারণত সাংস্কৃতিক দলে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকায় একজন নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে পরে যৌনদাসী হিসেবে বিক্রি করা হয়। ভিজিট ভিসা নিয়েও একই ঘটনা ঘটেছে। সূত্র বলছে, বাংলাদেশ হয়ে প্রথমে ভারতের মুম্বাই, এরপর পাকিস্তানের করাচি হয়ে বাংলাদেশি নারী-কিশোরীরা চলে যাচ্ছে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। আর স্থানীয় পাচারকারীরা দেশের ১৬টি জেলার ২০টি ট্রানজিট পয়েন্ট ব্যবহার করে নারী-শিশু ও কিশোরীদের পাচার করছে। যার উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই যাচ্ছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কন্যাশিশু পাচারের ঘটনাও আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এদের ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে। জানা যায়, ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের মাত্র তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় কিনে দালালচক্র ভারতের জয়পুর, ষোধপুর, মুম্বাই, দিল্লি ও পুনের পতিতালয়ে ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। তবে ভারতের কলকাতা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও সীমান্তবর্তী মানব পাচারের কেন্দ্রস্থল। কলকাতার সঙ্গে বাংলাদেশের ২ হাজার ২২০ কি.মি. স্থলসীমান্ত এবং ২৫৯ কি.মি. জলসীমান্ত আছে। আর এই সীমান্তের অনেক অংশই উন্মুক্ত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, নদীয়া, মালদা এবং কোচবিহার দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে নারী ও কিশোরীদের পাচার করা হচ্ছে। পরে এসব এলাকা থেকে মেয়েগুলোকে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে উদ্ধারের পর ভিকটিম ভেরিফিকেশনসহ বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ফলে ভারতের শেল্টার হোমগুলোতে অনেক বাংলাদেশি মেয়ে দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশি ভিকটিমদের আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং এ বিষয়ে ভীত হওয়ায় উদ্ধারের পরও পতিতালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে চায় না। এজন্য তারা আইনি সহযোগিতাও কম পায়। আর পাচারের পর দেশে ফিরে আসলেও লোকলজ্জার কারণে পাচারের শিকার নারীদের নানা কটুকথা শুনতে হয়। পরিবার তাদের আর গ্রহণ করতে চায় না। পরিবারের কাছে তারা এক ধরনের বোঝা এবং স্বজনদের কাছে তারা হয়ে উঠে অনাকাঙ্ক্ষিত। এজন্য বাধ্য হয়ে অনেকেই পরিবার ছেড়ে শহরে কাজের আশায় আবার চলে যায়। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের পুলিশ ভিকটিমের চিহ্নিতকরণ কাজটি করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। অনেক সময় তারা ভিকটিমের পরিবারের কাছে এজন্য টাকাও দাবি করে। পাচারকারীরা আগের তুলনায় আরও বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। তবে পাচার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দেশ থেকে যেসব নারীকে গৃহকাজের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করা হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যককেই পরে যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব নারী শ্রমিক বিভিন্ন রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির মাধ্যমে লেবানন ও জর্ডানের উদ্দেশ্যে গৃহশ্রমের জন্য যান, তাদের পরে সিরিয়ায় পাচার করে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদেরই একজন শাহিনুর বেগম। শাহিনুরকে জর্ডানে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেওয়ার কথা বলে দুবাই হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে তাকে বেশ কয়েকবার বিক্রি করা হয়। সিরিয়ায় দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয় শাহিনুরকে। তাকে তার গৃহকর্তা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে প্রতিদিন শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করত। এমনকি কাজ করতে না চাইলে শাহিনুরকে মেরে পা ভেঙে দেওয়া হয়। অতঃপর শাহিনুর বহু কষ্টে দেশে তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে শাহিনুরের মা মেয়েকে উদ্ধারের জন্য র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এর সাহায্য নেয়। র‍্যাব বর্তমানে শাহিনুরসহ এ ধরনের মোট ৪৫টি ঘটনায় বিদেশে পাচার হওয়া বাংলাদেশি নারীদের উদ্ধারের জন্য কাজ করছে। তবে সিরিয়ায় বাংলাদেশের অ্যাম্বাসি না থাকায়, ভিকটিমরা আইনি সহযোগিতা পাবে না এই যুক্তিতে দালালরা সিরিয়ায় নারী পাচার বেশি করে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

পাঠকের মতামত: