ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

চট্টগ্রামকে অবহেলার কোনো সুযোগ নেই ।। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্বোধনকালে শিল্পমন্ত্রী আমু

amu,.নিজস্ব  প্রতিবেদক  :::

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, দেশের আমদানি রপ্তানির সিংহভাগ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। আর জাতীয় রাজস্ব আয়ের ৬০ শতাংশ এ চট্টগ্রাম থেকেই আহরিত হয়। সুতরাং চট্টগ্রামকে অবহেলার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বন্দুকের জোরে ক্ষমতায় আসীন হওয়া প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও জিয়া দু’জনই উত্তরবঙ্গের। দু’জনের আমলেই উত্তরবঙ্গ ও মঙ্গা সমার্থক ছিল। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর এ মঙ্গার কথা ভুলতে বসেছে উত্তরবঙ্গের মানুষ।

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ৩০ লাখ শহীদ, বঙ্গবন্ধুর যোগ্য প্রতিচ্ছবি, দেশের স্বাধীনতাসার্বভৌমত্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক আখ্যায়িত করে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, উল্লেখিত কারণে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) যখন ক্ষমতায় আসেন তখন মনে করেন তাকে (প্রধানমন্ত্রী) ষোলকোটি মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে উন্নয়ন ও অগ্রগতি দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সবসময় নিজেকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো একজন মনে করেন।

তিনি বিগত সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের তুলনা করতে গিয়ে বলেন, ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার সময় ১৭ লাখ টন খাদ্য মজুদ ছিল। জোট সরকার ক্ষমতার আসার পর আবার দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিল।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হলে তখনও ২৬ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি রেখে যায় পূর্ববর্তী সরকারগুলো। কিন্তু আজকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের সামনে প্রমাণ করেছি। খাদ্য রফতানি করছি আমরা। তার মানে কি, এর পার্থক্য কি, তা আমাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে।

গতকাল রোববার বিকেলে পলোগ্রাউন্ড মাঠে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত ২৫তম চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখছিলেন মন্ত্রী আমির হোসেন আমু।

৩০ লাখ শহীদের কাছে শেখ হাসিনার জবাবদিহিতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন একটি সুখি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের। যে কারণে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছিল সেই আশাআকাঙ্খা যদি পূরণ না হয় সেই ৩০ লাখ লোকের আত্মার কাছে শেখ হাসিনার জবাবদিহিতা রয়েছে। আমাদের জবাবদিহিতা রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় আসেন তখন তাঁর চোখের সামনে ওই দৃশ্যগুলো বারবার আসে বলেই তিনি মানুষের জন্য দেশের জন্য অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন। রাতের ঘুমকে হারাম করে এ দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছিলেন কিন্তু সেই সময় পাশ্ববর্তী দেশের সাথে করা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমাদের দেশের কোন সীমা রেখা ছিল না।

৪০ বছর পর্যন্ত যারা সরকার পরিচালনা করেছে তারা কোনদিন বাংলাদেশের সীমানা নিয়ে চিন্তা করেনি। শেখ হাসিনা মুজিব ইন্দিরা চুক্তি নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাস্তবায়ন করেছেন। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার মাধ্যমে জলসীমা নির্ধারণ হয়েছে। অর্থাৎ আমরা এখন একটি পরিপূর্ণ দেশ।

মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ বান্ধব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করতেই সরকার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগী হচ্ছে। এ কারনে চট্টগ্রাম অঞ্চলে টেকসই ও সুসংহত শিল্পখাত বিকাশের পাশাপাশি উৎপাদিত শিল্পপণ্য বৈচিত্রকরণে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ইতিবাচক অবদান রাখছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। একইসাথে শিল্প মন্ত্রণালয় প্রণীত জাতীয় শিল্পনীতি২০১৬ এ বেসরকারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতি সহায়তা বাড়ানো হয়েছে। শিল্প মন্ত্রী ২০১৫১৬ অর্থ বছরে জিডিপিতে সার্বিক শিল্পখাতের অবদান ৩১.৫৪% যেখানে ম্যানুফেকচারিং শিল্পখাতে মোট প্রবৃদ্ধি ১১.৬৯% উল্লেখ করে তৈরী পোষাক শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, জুতা ও ঔষধ শিল্পের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলমের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি আরো বলেন, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে বিএনপি ৩০ লাখ শহিদের আত্মাকে অপমান করেছিল। আর জননেত্রী ক্ষমতায় এসে রাজাকার আলবদর নেতাদের বিচার করে শহীদদের আত্মাকে শান্তি দিয়েছেন।

মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে এসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে যদি দেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে না পারি।

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে জাতির পিতা যখন দ্বিতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তেই তাকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। শুধু হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। ইতিহাসের চাকা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আবার এদেশকে সাম্প্রাদয়িকতার বিষবাষ্পে নব্য পাকিস্তান সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এ বাংলার মানুষ তা ব্যর্থ করে দিয়েছে। জাতীয় চার মূলনীতি ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। এই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সেই ধারা তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবেশ ঘটানো হলো। গোলাম আজমের নাগরিকত্ব না থাকা সত্ত্বেও তাকে দেশে রাজনীতি করবার সুযোগ করে দেয়া হলো।

শিল্পমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি শুধু নয়, সেদিন যারা পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মানুষ জবাই করেছিল সেই সমস্ত চিহ্নিত রাজাকার আলবদরআল শামসদের গাড়িতে পতাকা দেয়া হয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকারের তরফে। এর মাধ্যমে দেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চেতনাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে।

মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, জিডিপিতে ব্যবসায়ীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে হবে। তিনি বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বেগবান করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে রিং রোড নির্মাণ করে যানজট নিরসন ও শহরের মূল সড়কের উপর অত্যাধিক চাপ হ্রাস করা সম্ভব।

তিনি আরো বলেন, দেশকে উন্নত করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে গৃহীত পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। গ্যাস সংকট বর্তমানে ব্যবসার প্রধান সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর সমাধানে দ্রুতগতিতে কাজ করছে সরকার। এছাড়া নগরীর বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে মন্ত্রীর সহযোগিতাও চান তিনি।

এফবিসিসিআইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্য বিকাশে বিশেষ করে রপ্তানী পণ্যের প্রচার, বাজার সম্প্রসারণ এবং পণ্যের মানোন্নয়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন একটি প্রয়োজনীয় ও যথার্থ উদ্যোগ। তিনি রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে দেশীয় রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি কারখানার উৎপাদন পরিবেশ, নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স বিষয়গুলো প্রতিপালনের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

তিনি আরো বলেন, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের গতি আরো শাণিত করতে অর্থনৈতিক কুটনীতির উপর জোর দিতে হবে। শুধু তৈরী পোষাক শিল্পের উপর ভরসা করে বসে থাকলে হবে না। পণ্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে বহুমুখীকরণ এখন সময়ের দাবি।

সভাপতির বক্তব্যে মাহবুবুল আলম বলেন, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিপননে এ মেলার ব্যাপক ভুমিকা রয়েছে। এ লক্ষে মেলা আয়োজনের জন্য আমরা একটি স্থায়ী ভ্যানু চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়ে উঠেনি। তাই প্রতিবছর মেলা আয়োজনে আমাদের কষ্ট হয়। চট্টগ্রাম চেম্বার শুধু নয়, বড় পরিসরে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন চেম্বার ও ওমেন চেম্বারও নগরীতে মেলা করে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে একটি স্থায়ী ভ্যানু এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তিনি এক্ষেত্রে রেলওয়ের বিপুল অব্যবহৃত জায়গার কথা উল্লেখ করেন।

তিনি আরো বলেন, আমাদের রপ্তানি আয় বর্তমানে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়নে উন্নীত করার প্রত্যয় রয়েছে। এ লক্ষে আামাদেরকে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা না বাড়লে দেশ এগুবে না।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কন্টেনার টার্মিনাল ও বে টার্মিনাল গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। নগরীর কাট্টলী এলাকায় সাগর সাইডে বে টার্মিনাল করা যায়। যাতে ১৩ মিটারের জাহাজ ভিড়তে সমস্যা না হয়। ১০০ বছরের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখেই এ কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করা জরুরি।

মাহবুবুল আলম বলেন, বন্দর ও কাস্টমস একে অপরের পরিপূরক। তাই কাস্টমসের কাজ ব্যাহত হলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর বর্তমানে কাস্টমসে লোকবলের তীব্র সংকট চলছে। এটার দ্রুত সমাধান না করলে ব্যবসার ক্ষতি হবে। ক্ষতির মুখে পড়বে দেশের রাজস্ব আহরণ। তিনি ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রিকরণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ব্যাংকগুলোকে যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। আর প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকায় হওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না চট্টগ্রাম থেকে। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।

চেম্বারের সিনিয়র সহসভাপতি ও মেলা কমিটির চেয়ারম্যান নুরুন নেওয়াজ সেলিম বলেন, এ মেলা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বৃত্তে আবদ্ধ নেই। এটা বিনোদনের ক্ষেত্র হিসেবেও পরিগণিত হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসা বাণিজ্যের গতি বাড়ানো ও বেসরকারি খাতের উন্নয়নে এ মেলা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার অনরারি কনসাল, ভারতের সহকারি হাইকমিশনার, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেকসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ।

 

পাঠকের মতামত: