ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে চকরিয়ায় ২০ হাজার একর ফসলি জমি ।। কয়েকশ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে কৃষকরা, খুলে দেয়া হলো ১৫টি স্লুইস গেট ও রাবার ড্যাম

images.duckduckgo.comছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ।।

বৈরী আবহাওয়ায় টানা তিনদিনের হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতে চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর পানিতে ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার একর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি ভাটির দিকে নামতে না পেরে লোকালয় ও জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে এসব সবজি ও ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে যায়।

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, গত তিনদিন ধরে এসব ফসলি জমি পানিতে ডুবে থাকায় ১১ ইউনিয়নের অন্তত ২০ হাজার প্রান্তিক চাষির প্রায় ২০ হাজার একর জমিতে ফলানো কয়েকশ’ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় জমে থাকা পানি ভাটির দিকে নেমে যেতে দু’দিন আগে পেকুয়ার ভোলা খালের ওপর নির্মিত রাবার ড্যামটির রাবারের হাওয়া ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি না হওয়ায় পালাকাটারামপুর পয়েন্টের ড্যামের রাবারের হাওয়া গতকাল বিকেলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া খুলে দেয়া হয়েছে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ১৫টি ুইস গেট। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঘগুজারা রাবার ড্যামের দক্ষিণাংশ দিয়ে ছড়া কেটে পানি ভাটির দিকে নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে বিকেল থেকে ভাটির দিকে পানি নামতে শুরু করেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা তারেক বিন ছগির জানান, গত শুষ্ক মৌসুমের শুরুতে মাতামুহুরী নদীর বাঘগুজারা পয়েন্টে রাবার ড্যাম ছিঁড়ে নদীতে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছিল। এ সময় লবণাক্ত পানি থেকে ফসলি জমি রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় কক্সবাজারের কর্মকর্তারা এই ড্যাম পরিদর্শন করেন। এরই প্রেক্ষিতে ড্যামটি নতুন করে মেরামতের জন্য ড্যামের দু’দিকে নদীতে দু’টি মাটির অস্থায়ী ক্রসবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ১৫ দিন আগে মাটির এই বাঁধ দু’টি নির্মাণের কাজ শেষ হলে বর্তমানে ড্যাম মেরামতের কাজ চলছে। এই কাজ সম্পন্ন করতে আরো অন্তত একমাস সময় লাগতে পারে। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে বৈরি আবহাওয়ার সঙ্গে হালকা ও মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হওয়ায় পাহাড়ের উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানি নদী উপচে লোকালয় ও ফসলি জমিতে ঢুকে পড়ে। এতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় পানির নিচে তলিয়ে যায় এখানকার বসত বাড়ি ও ফসলি জমি।

তারেক বিন ছগির আরো জানান, ‘কৃষকদের দাবির প্রেক্ষিতে এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনায় জমে থাকা পানি ভাটির দিকে সরিয়ে দিতে পালাকাটারামপুর পয়েন্টে রাবার ড্যামের হাওয়া একেবারে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাঘগুজারা ড্যামের দক্ষিণাংশে ছড়ার মতো কেটে দিয়ে নদী এবং লোকালয়সহ ফসলি জমিতে আটকে পড়া পানি নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে পানি নামতে শুরু করেছে।’

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ জানান, ‘বাঘগুজারা রাবার ড্যামটি মেরামতের জন্য দু’দিকে তৈরি মাটির অস্থায়ী ক্রসবাঁধ বিদ্যমান থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কৃষকের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বিকল্প পন্থায় এবং নদীর পালাকাটারামপুর পয়েন্টে নির্মিত রাবার ড্যামের হাওয়া সোমবার (গতকাল) বিকেলে সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এতে ভাটির দিকে পানি নামতে শুরু করেছে। আশা করছি রাতের মধ্যেই নদী ও লোকালয়সহ ফসলি জমিতে ঢুকে পড়া পানি দ্রুত নেমে যাবে।’

বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ‘হঠাৎ প্রকৃতির বৈরী আচরণ ও তিনদিনের একটানা হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত কৃষকের জন্য গলার কাটা হয়ে গেছে। এই অবস্থায় নদীতে উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং বৃষ্টির পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে না পেরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ফসলি জমি ও লোকালয়সহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো তলিয়ে গেছে। এতে আমার ইউনিয়নে কমপক্ষে তিন হাজার একর জমির ফসল একেবারে নষ্ট হয়ে কৃষকরা কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছে।’

তিনি জানান, ‘নদীতে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির পানিতে গত কয়েকদিন ধরে ডুবে রয়েছে বাইন্যাবিল, ডেইঙ্গাকাটা বিল, বরইতলী বিল ও পহরচাঁদার পশ্চিমাংশ। এছাড়াও হারবাং বড়বিলের রকমারী সবজি ক্ষেত বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে ইউনিয়নের অসংখ্য গ্রাম। এতে এসব গ্রামের কয়েক হাজার পরিবারও পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।’

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার হারবাং, বরইতলী, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, কাকারা, সুরাজপুরমানিকপুর, বিএমচর, পূর্ব বড় ভেওলা, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী (কিছু অংশ) এবং চকরিয়া পৌরসভার লক্ষ্যারচর, আমাইন্যারচরসহ আশপাশের বেশকিছু এলাকায় ফসলি জমি (ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত, বাদাম ক্ষেত, তামাক ক্ষেত) ছাড়াও গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এই অবস্থায় শুধুমাত্র সবজি ও ধানক্ষেত নিয়ে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কৃষকরা। এতে কম করে হলেও কয়েকশ’ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে এসব ইউনিয়নের অন্তত ২০ হাজার প্রান্তিক কৃষকের।

এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এমনিতেই বরইতলী ডেইঙ্গাকাটাসহ আশপাশের এলাকাটি একেবারে নিচু। সামান্য বৃষ্টি হলেই ওখানে মাসের পর মাস পানি জমে থাকে। এই অবস্থায় বাঘগুজারা রাবার ড্যামের মেরামত কাজের জন্য দেয়া মাটির বাঁধের কারণে পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না।’

ইউএনও আরো বলেন, ‘এই অবস্থায় বাঘগুজারা ড্যামের দক্ষিণাংশে বিকল্প ছড়া কেটে এবং নদীর পালাকাটারামপুর পয়েন্টের রাবার ড্যাম সম্পূর্ণ ডাউন করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পেকুয়ার ভোলা খালের ওপর নির্মিত ড্যামের রাবারও কয়েক ফুট ডাউন করা হয়েছে। পাশাপাশি চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার অন্তত ১৫টি ইস গেট খুলে দেয়া হয়েছে যাতে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারে। তবে সামুদ্রিক জোয়ারের প্রভাব থাকায় খুলে দেয়া ইস গেট দিয়ে যাতে উল্টো লবণাক্ত পানি ঢুকতে না পারে সেজন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে। এতে আশা করছি, দ্রুত এসব পানি নেমে যাবে।’

 

পাঠকের মতামত: