ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

দালানকোঠার ভারে বিপন্ন প্রবালদ্বীপ

s.mrtn_-1জাহিদুর রহমান, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে :::

ভাটার সময় সেন্টমার্টিনে জমির পরিমাণ আট বর্গকিলোমিটার আর জোয়ারের সময় পাঁচ বর্গকিলোমিটার। কতটুকুইবা জমি? এর ওপরও চোখ পড়েছে দখলবাজদের। দ্বীপের রয়েছে তিনটি অংশ- উত্তরপাড়া, দক্ষিণপাড়া আর দুই অংশের মাঝখানটা গলার মতো সরু বলে গলাচিপা নামে পরিচিত। এই তিন অংশের মাঝে উত্তর অংশ মূলত জনপদ। গলাচিপায় কিছু ভালো কটেজ, নৌবাহিনীর স্থাপনা আর কিছু স্থানীয় মানুষের বসবাস।

নারিকেলগাছ আর আবাদি জমির বেশিরভাগই এ অংশে। দক্ষিণ অংশ এখন পর্যন্ত ‘রেস্ট্রিকটেড অ্যাকসেস জোন’ হিসেবেই পরিচিত। সেখানে পড়ে আছে বিশাল বিশাল প্রবাল পাথর। দক্ষিণপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে শুধু জমি মালিকানার সীমানা আর সাইনবোর্ড। সীমিত প্রবেশাধিকার জোনের জমিগুলোও বিক্রি হয়ে গেছে। শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর সরিয়ে মাটি বের করা হচ্ছে কটেজ বানানোর জন্য। শুধু তাই নয়, প্রবাল পাথরের টুকরাগুলো দিয়ে বানানো হচ্ছে প্লটের সীমানাপ্রাচীর। স্থানীয়রা জানান, পর্যটনশিল্প বিকাশের দোহাই দিয়ে ৯০ দশকের পর থেকে সেন্টমার্টিনে একের পর এক গড়ে ওঠে প্রাসাদ। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। নির্দেশনা মতে, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনো স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও সেখানে গড়ে উঠছে একের পর এক স্থাপনা।

গত মাসে ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) নামে কক্সবাজারের স্থানীয় একটি সংস্থা সেন্টমার্টিনের হোটল-রিসোর্টের ওপর একটি জরিপ করে। সে জরিপে নির্মাণাধীনসহ ১০৬টি হোটেল-রিসোর্টের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। তারা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালককে একটি আবেদন জমা দেয়। আবেদনে তারা জানায়, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি চলছে সরকারি স্থাপনার কাজ। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন সমকালকে বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নির্মিত এবং নির্মাণাধীন আবাসিক হোটেলের একটি তালিকা তৈরি করেছি। তালিকাটি আমলে নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করলে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেন্টমার্টিন দ্বীপে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, দ্বীপের ডেইলপাড়া রাস্তার পাশে ‘হোটেল ফ্যান্টাসি’ নামে একটি বিশাল ভবনের কাজ চলছে। ৩০ জনের মতো শ্রমিক নির্মাণকাজ করছেন। এরই মধ্যে প্রায় কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা ওই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডেও রয়েছে আলিশান কক্ষ ও সুইমিংপুল। নির্মাণ শেষ হওয়া অংশে রয়েছে চোখধাঁধানো সব ফিটিংস ও আলোকসজ্জার কাজ। পশ্চিম কোনাপাড়া সৈকতের সঙ্গে লাগোয়া ‘রিসোর্ট লাবিবা বিলাস’। সেখানেও তৃতীয়তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ চলছে প্রকাশ্যে।

এ দু’টি ভবন ছাড়া আরও ১০-১৫টি ছোট-বড় স্থাপনার নির্মাণকাজ চলছে। দ্বীপ ঘুরে দেখা যায়, দ্বীপের উত্তর অংশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে ৮৪টিরও বেশি হোটেল-মোটেল ও ২৮টি রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় সূত্রমতে, গত পাঁচ বছরে ৫৬টির মতো বহুতল হোটেল তৈরি হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থাপনা নির্মাণ করতে গেলেই রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সরকারি কিছু কর্মকর্তার একটি চক্রকে ম্যানেজ করতে হয়। তাদের যোগসাজশে প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে প্রায় নয় কিলোমিটারের সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইট, লোহা, সিমেন্ট, বালুসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী পেঁৗছে যায় সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর ম্যানেজ থাকায় এসব নির্মাণসামগ্রী নির্বিঘ্নে নির্মাণস্থলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সেখানেও কোনো বাধা ছাড়াই গড়ে উঠছে হোটেল, কটেজ ও রেস্তোরাঁ। আবার অনেক সময় দ্বীপের তিন দিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক পাথর ব্যবহৃত হচ্ছে অবকাঠামো তৈরিতে।

দ্বীপে হোটেল ছাড়াও নির্মিত হয়েছে পাকা পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, আবহাওয়া ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠান। সেন্টমার্টিনের গলাচিপা এলাকাটি এ দ্বীপের সবচেয়ে সংকীর্ণ এলাকা। এখানে দাঁড়ালে একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমের সমুদ্র চোখে পড়ে। দ্বীপটির পরিবেশ ব্যবস্থার জন্য স্পর্শকাতর এ জায়গায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী নির্মাণ করেছে মেরিন পার্ক ও ‘কোরাল ভিউ’ নামে পাকা গেস্টহাউস।

দ্বীপে রাস্তার একপাশ ও সৈকতের পাড় দখল করে অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে শতাধিক দোকান। এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে শুঁটকি, শামুক-ঝিনুকের পণ্য, কাপড়চোপড় ও রকমারি খাবারদাবার।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. রাশেদ-উন-নবী বলেন, ‘জায়গা বিশেষে ১২ থেকে ২০ ফুট মাটির নিচেই পাথরের স্তর রয়েছে সেন্টমার্টিনের। এভাবে ভবন তৈরি হলে দ্বীপের মাটিতে ফাটল দেখা দিতে পারে, এমনকি পাথরের স্তরটিও ভেঙে যেতে পারে।’

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে ইট-সিমেন্ট-রডসহ নির্মাণসামগ্রী আনতে উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি লাগে। এ কারণে স্থানীয় লোকজন ঘর তৈরি করতে পারেন না। অথচ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নানা কৌশলে ইট-সিমেন্ট নিয়ে আসছেন।’

দৈনিক সমকাল।

পাঠকের মতামত: