আবু তাহের :
‘সাংবাদিকের কলম কামানের চেয়ে শক্তিশালী’ সম্রাট নেপোলিয়নের এই উক্তি একজন সাংবাদিকের মর্যাদা নির্ণয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও আর নেই। স¤্রাট নেপোলিয়নও বেঁচে নেই। হাল আমলে সাংবাদিকতায় কলমের ব্যবহার যেমন সংকুচিত হয়ে আসছে, তেমনি এই জাতির মর্যাদার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। হলুদ সাংবাদিকতা এখন সাংবাদিকের গায়ে রং ছড়িয়েছে। দলীয় সাংবাদিকতা এই জাতির মান মর্যাদাকে লুন্ঠিত করেছে। হলুদ সাংবাদিকতা আর দলীয় সাংবাদিকতা একে অপরের ভিতরে প্রবেশ করে এই পেশাকে মহাদুর্যোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
দলীয় সাংবাদিকতা কিভাবে সৎ সাংবাদিকতাকে কলংকিত করে তাঁর একটি উদাহারণ দেয়া যায়। জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মামলায় রায়ের পর তাঁর কর্মী সমর্থকরা কর্মসূচি ঘোষনা করে। জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে সারা দেশে যখন অরাজকতা চলছে তখন ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় ছবি সহকারে একটি সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়। সেখানে বলা হয় মাওলানা সাঈদীর মুক্তির দাবিতে পবিত্র কাবা শরীফের ইমামগণ কর্মসূচি পালন করেছে। সাথে একটি ছবি দেয়া হয়। মূলত এই ধরণের কোন কর্মসূচি পবিত্র কাবা শরীফের ইমামগণ পালন করেননি। ছবিটি ছিল কাবা ঘরের গিলাফ বদলানোর একটি ছবি। দলীয় সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এই ধরণের হলুদ সাংবাদিকতার অসংখ্য উদাহারণ দেয়া যায়।
দলীয় সাংবাদিকতা এখন রাজধানীর সীমানা পেরিয়ে জেলা উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। পর্যটন শহর কক্সবাজারেও তার কমতি নেই। রাজনীতিকরা দল করছেন, সাথে একটি পত্রিকার লাইসেন্স নিয়েছেন। তাঁর খবর, তাঁর দলের খবর সেখানে অতিগুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। বাড়তি সুবিধা হচ্ছে অন্য কোন পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে খবর আসলে পাল্টা আঘাত করার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবেও পত্রিকাকে ব্যবহার করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতারা কেবল এই সুযোগ নিচ্ছে তা নয়। কেউ ব্যবসায়ী নেতা, কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, কেউ সুশীল সমাজের নেতা সমাজে প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য তাঁরও একটি পত্রিকা প্রকাশ করা চাই।
ডিজিটাল যুগে পত্রিকা প্রকাশনা অতি সহজ হয়ে গেছে। একটি কম্পিউটার এবং জনা দুয়েক পার্ট টাইম কর্মী হলেই পত্রিকা প্রকাশ করা যায়। খন্ডকালিন এই কর্মীদের বেতনও দিতে হয় না। বরং একটি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে দৈনিক বা মাসিক হারে টাকাও আদায় করে থাকে এই পত্রিকা মালিকরা। কেউ কেউ পত্রিকাকে মাসিক হারে ভাড়াও দিয়েছে। বাসা ভাড়ার মত পত্রিকা ভাড়ার হারও বৃদ্ধি পায়। ভাড়া বকেয়া পড়লে পত্রিকা প্রকাশনা অন্য কারো হাতে চলে যায়। এমন ব্যবসা ডিজিটাল যুগে সাংবাদিকতাকে মহান (!) করেছে কিনা জানি না তাঁর চেয়ে ভয়াবহ সংবাদ আমার জানা রয়েছে।
এমন কিছু লোকের কথা জানি যাঁরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়েও হাঁটেনি। পত্রিকা পড়তে পারা দুরে থাক, কোন প্রকারে দস্তখত করতে আধা ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। এমন ব্যক্তিও সম্পাদক প্রকাশক হয়ে দৈনিক পত্রিকার লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। টাকা দিলে পত্রিকার লাইসেন্স পাওয়া এখন কোন ব্যাপার নয়। পত্রিকার লাইসেন্সের সাথে একটি মুদি দোকানের লাইসেন্সের আর কোন তফাৎ নেই। এই শহরে মুদি দোকানের সংখ্যার চেয়ে পত্রিকার সংখ্যাও কম নয়।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রচারিত মিডিয়াও কম নজির তৈরি করছে না। কোন মিডিয়া মাসিক পঞ্চাশ হাজার থেকে লাখ টাকা বেতনে সাংবাদিক নিয়োগ করছে। আবার কোন মিডিয়া উল্টো সম পরিমাণ টাকা মাসিক নিয়ে সাংবাদিক(!) নিয়োগ দিচ্ছে। কি বিচিত্র এই দেশ। সম্রাট নেপোলিয়ন যদি আজ বেঁচে থাকতেন নিশ্চয় আতœহত্যা করতেন।
এক সময় হদুল সাংবাদিকতার সংজ্ঞা দেয়া হত এভাবে : ক) সাধারণ ঘটনাকে সাংঘাতিক অতিরঞ্জিত করে বড় শিরোনামে ছাপানো (খ) ছবি আর কাল্পনিক ছবির অপরিমিত ব্যবহার করা (গ) ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম দেয়া (ঘ) অহেতুক চমক সৃষ্টি করে যেনতেন ভাবে পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি। কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার ধরণ পাল্টে গেছে। এখন আর সাংবাদ প্রকাশ করতে হয় না। মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ অথবা সমাজে কলংকিত করার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় হলুদ সাংবাদিকতা, না কালো সাংবাদিকতা- কোন শ্রেণীতে ফেলা যায় জানি না এর চেয়ে জঘন্য কান্ডকারখানা সাংবাদিকতার নামে হচ্ছে এই সমাজে।
নিজের অন্যায় ব্যবসাকে সুরক্ষা দিতে এবং সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করতে অধিকাংশ ব্যক্তি মিডিয়া মালিক হচ্ছেন। এই উদ্যোক্তারা স্বাধীন গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় বিপদ। তারা প্রতি পদে পদে স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করছে। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নগদ পাওনার লোভে সাংবাদিকরা সহজেই এইসব উদ্যোক্তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। আজকে সৎ ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেধাবীরা এখন সাংবাদিকতা পেশায় কম আসছেন।
লোভের কাছে নতজানু না হয়ে, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে, পেশার প্রতি সৎ থাকার কঠিন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে কিছু লোক এখনও সাংবাদিকতার মহান পেশাকে আঁকড়ে ধরে রয়েছেন। সাংবাদিকতা পেশায় নোংরা জঞ্জালের মধ্যে বসবাস করেও এঁরা মিডিয়া ও সাংবাদিকতার মর্যাদাকে মাথায় তুলে রেখেছেন। এই সৎ ব্যক্তিদের জন্যই এখনও সাংবাদিকরা সাধারণ মানুষের কাছে শেষ ভরসা আশ্রয়স্থল। সেইসব সাংবাদিকের জন্য শুভ কামনা।
এই লেখা যখন শেষ করেছি তখনই খবর পেলাম সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন সমকালের প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল। এভাবে সাংবাদিক নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনা এদেশে নতুন নয়। এর আগে সাংবাদিক শামশুর রহমান, হুমায়ুন কবির বালু, মানিক সাহা, সাগর-রুনি সহ আরো অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তাঁদের কোন বিচার এখনও হয়নি। সাংবাদিকতা পেশা ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তারপরও সাংবাদিকরা বিপদ মাথায় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রভাব প্রতিপত্তিশালী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। নিশ্চয় এই সমাজ এই দেশের মানুষ সৎ ও ন্যায়বান সাংবাদিকদের এই আতœত্যাগকে মূল্যায়ন করবে। গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। আমার বিশ্বাস এদেশের মানুষ সকল পেশী শক্তির বিরুদ্ধে, সকল অনাচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে। নিশ্চয় সাংবাদিকদের এই আতœত্যাগ একদিন সমাজের জন্য, জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক : কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। [email protected]
প্রকাশ:
২০১৭-০২-১৫ ১০:৪৩:১২
আপডেট:২০১৭-০২-১৫ ১০:৪৩:১২
- চকরিয়াতে দুই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নামসর্বস্ব অবৈধ হাসপাতালে কর্তৃপক্ষের নজরদারী নাই
- লামা বনবিভাগের মানিকপুর রিজার্ভে পাহাড়কাটার ধুম: নিরব প্রশাসন
- চকরিয়ায় বাড়ির পাশে ট্রেন দেখতে গিয়ে কাটাপড়ে কিশোরী মাদারাসা ছাত্রীর মৃত্যু
- চকরিয়ায় ধানক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে দলছুট বন্যহাতির আক্রমণে কৃষক নিহত
- চিরিংগা হাইওয়ে থানার ইনচার্জ মাহবুবুল হকের চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে শ্রমিকদের মানববন
- চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ জেলের মরদেহ ১৯ ঘন্টা পর উদ্ধার
- চকরিয়ায় সাড়ে ৫ কেজি গাঁজাসহ পেশাদার মাদক কারবারি গ্রেফতার
- পুলিশের কাছ থেকে হাতকড়াসহ পালাল আসামি
- রামুতে ৬টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান
- চকরিয়া ৩৪ বছরের চলাচলের রাস্তা দখলমুক্ত করলেন ইউএনও, খুশি এলাকাবাসী
- চকরিয়ায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মুহূর্তে পুড়ে ছাই ৫ বসতঘর, ৪০ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন
পাঠকের মতামত: